সোমবার, ৫ মার্চ, ২০১২

মাঝরাতের ফোন কল

আঁতেল সিরিজের ৩য় গল্পঃ


by Oritro Ahmed
ফোনের শব্দে আরিফের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।কে গো এতো রাতে? ডিস্প্লেতে দেখে অপরিচিত নম্বর। মেজাজ খারাপ করে আরিফ ফোন ধরলো।ওপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে এলো
"হ্যালো আরিফ?"
আরিফ নারী কন্ঠ শুনে একটু অবাক হলো। এতো রাতে অপরিচিত নম্বর থেকে কোন মেয়ে ফোন দিলো ওকে?
"জ্বী আমি আরিফ বলছিলাম,আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।"
ওপাশ থেকে মেয়েটা হেসে বলল
"ব্রেনের ওপর চাপ দিয়ে লাভ নাই,আপনি আসলেও আমাকে চেনেন না"
এ কথা শুনে আরিফ উঠে বসলো বিছানা থেকে।সে মেয়েটাকে চেনে না কিন্তু মেয়েটা তাকে চেনে।আরিফ এবার নিজে থেকেই একটু আগ্রহী হলো।
কে এই মেয়ে এবং কেনই সে আরিফ কে মাঝ রাতে ফোন দিয়েছে?
"আপনাকে আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি?" আরিফের প্রশ্ন ।
"আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই" অপরিচিতার উত্তর।
"আমি আপনাকে চিনি না,জানি না।আমি কেন আপনার সাথে কথা বলবো?"আরিফের জবাব।
ওপাশ থেকে রহস্যময়ী খিল খিল করে হেসে উঠলো।হাসি শুনে আরিফ কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলো।স্মৃতির পাতা থেকে
কিছু একটা ভেসে উঠতে গিয়েও উঠলো না।এ হাসি আরিফের অপরিচিত না,এ হাসির মালিক এর মুখটা আরিফের
স্মৃতির মানস্পটে ভেসে উঠলো।নিজের ভাবাবেগ কে চাপা দিয়ে আরিফ বলল?
"হাসছেন কেন?"
ওপাশ থেকে আবার হাসি শোনা গেলো।
"ওমা হাসতে মানা আছে নাকি?আগে বলবেন না?আচ্ছে আর হাসবো না।"
তবে তার হাসি থামানোর কোন লক্ষন দেখা গেলো না।সে ক্রমাগত হেসে চলেছে।
আরিফের খুব খারাপ লাগতে লাগলো।আবার সেই কষ্টের স্মৃতি মনে পরে যাচ্ছে।সে তাড়াতাড়ি বলল
"অনেক রাত এখন,আমি ঘুমতে যাবো।ভালো থাকবেন"।
ওপাশ থেকে হাসি থেমে গেলো।আরিফ কেবল ফোন টা কান থেকে নামাতে যাবে এমন সময় ওপাশ থেকে খুব ঠাণ্ডা গলায় খুব
আদর করে কেউ বলল "আরিফ তুমি কি আমাকে ভুলে গেছো?"
আরিফের মনে হলো তার বুকে কেউ যেন একটা চাকু ঢুকিয়ে দিয়েছে।এই সেই ভয়েজ,সেই আদুরে করে আরিফ ডাকা
,এটা কিভাবে হতে পারে?হ্রিদিতা কিভাবে ফিরে আস্তে পারে?ও তো আমাকে ছেড়েও চলে গিয়েছিলো।বলেছিলো আর
কখনো ওর কাছে আসবে না,ওর সাথে কথা বলবে না।
আরিফ প্রায় এক মূহূর্ত দম আটকে রেখে বলল
"হৃদিতা?তুমি?"
আবার হাসি শোনা গেলো।
"যাক মশাই তাহলে আমাকে চিনতে পেরেছেন?কেমন আছো আরিফ?"
আরিফ খুব আস্তে করে বলল
"তোমার তো ভালো জানার কথা আমি কেমন আছি?ছেড়ে তো আমাকে তুমি গিয়েছিলে?"
হৃদিতা এবার শান্ত ভাবে বলল
"তুমি কখনো জানার চেষ্টা করোনি কেন আমি তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম?কেন চেষ্টা করোনি আরিফ?"

আরিফ কয়েকসেকেন্ড কথা বলতে পারলো না।তার পর বলল
"তুমি আমাকে বলেছিলে তুমি আর আমার কাছে আসবে না,আমার সাথে কথা বলবে না,আমাকে নিষেধ করেছিলে তোমাকে ফোন দিতে,তোমার সাথে দেখা
করতে?তাইনা? তাহলে দোষ কি আমার?"

দ্বীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
"হ্যাঁ আমি তোমাকে মানা করেছিলাম,ভেবেছিলাম সেটাই মনে হয় ভালো ছিলো"

"কেন হৃদিতা?আমি তো অনেক ভেবেও তোমার এই হটাত চলে যাওয়ার কারন ভেবে পাইনি।না আমাদের ঝগড়া হয়েছিলো,না আমাদের ফ্যামেলি বিয়ে ঠিক করেছিলো। ?"

"আরিফ তোমার মনে আছে,তুমি কলেজ লাইফে আমাকে বলতে যে কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলো সামনে থেকে অদৃশ্য থাকে?মনে আছে তোমার? "

"কেন মনে থাকবে না?রহিমের ক্যান্টিন এ বসে তোমাকে বলেছিলাম এই কথা।"

"তোমার আমার ভালোবাসার ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে আরিফ,এমন কিছু বিষয় ছিলো যেটা আমি তুমি এক সাথে বসে দেখতে পারি নি,যখন দেখেছি তখন আমি তোমাকে এর মাঝে আনতে চাই নি"।

"কি সেই বিষয় যার কাছে তোমার আমার ভালোবাসাও তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিলো? আমি মনে করতাম আর যাই হোক তুমি অন্তত আমাকে ছেড়ে যাবে না"

"জিজ্ঞেস করো না কেন আমি চলে গিয়েছিলাম,আমি উত্তর দিতে পারবো না।এখন বলো তুমি কেমন আছো?বিয়ে করেছো?"

আরিফ এক মূহুর্ত থেকে বলল
"তোমার কি মনে হয় আমি বিয়ে করেছি?"

আবার ওপাশ থেকে সেই ভূবন ভোলানো হাসি শোনা গেলো।
"আরিফ তোমার মনে আছে আমি একটা সময় আমি তোমাকে বলতাম তোমাকে আমার চেয়ে ভালো করে কেউ চেনে না?মনে আছে তোমার?"

"তোমার যদি মনে হয় তুমি আমাকে এতো ভালো করে জানো তাহলে তোমার এটাও জানা থাকার কথা আমি সহজে কিছু ভুলি না"

"হুম,জনাব সহজে কিছু ভোলেন না।আমার ধারণা তুমি এখনো বিয়ে করনি ।অবশ্য তোমার বয়স খুব বেশী না,বিয়ে না করে আরো ২-৩ বছর অনায়েসে কাটাতে পারবে"

"তাই নাকি?"
"হুম,তুমি অনেক হ্যান্ডসাম ছিলে কলেজ লাইফে।তাইতো তোমার প্রেমে পরেছিলাম।নাহলে যার পেছনে গোটা কলেজের ছেলেরা ঘুরতো সে তোমার
প্রেমে কেমনে পরে?"

"তুমি কি নিজের প্রশংসা করছো নাকি আমার লেগ পুলিং করছো?"

আবার হাসি শোনা গেলো।
"কোনটাই করছি না,শুধু স্মৃতিচারণ করছি"।

"তুমি এখন কোথায় হৃদিতা?"

"আমি?তোমার খুব কাছে আছি।খুব কাছে।"
"ঠাট্টা রাখো,সিরিয়াসলি বলো কোথায় আছো?"
"আমি ঢাকাতে আছি আরিফ,গতকাল এসেছি"
"আমার ফোন নম্বর পেলে কি করে?মিনহাজ দিয়েছে?"

"হুম,মিনহাজ এর সাথে আমার ইউকে যাওয়ার পরো যোগাযোগ ছিলো"

"তুমি বিয়ে করেছো হৃদিতা?"

"তোমার কি মনে হয়?"

"আমার একটা সময় পর্যন্ত্ নিজের ওপর ভরসা ছিলো যে আমি তোমাকে সবচেয়ে ভালো জানি,যে দিন তুমি চলে গেলে সেদিন বুঝলাম আমি ভুল জানতাম,কোন আইডিয়া নাই তুমি বিবাহিত না অবিবাহিত"

"আমি এখনো বিয়ে করিনি আরিফ?"
"কেন?"
"কারো পথ চেয়ে আছি?"
একটা হালকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরিফ জিজ্ঞেস করলো  "কার?"
"তোমার,ইউ ঈডিয়েট"
বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠলো আরিফ "মানে?আমার অপেক্ষা করছো?ডোন্ট প্লে উইথ মি হৃদিতা।যদি আমার জন্যই অপেক্ষা করছো তাহলে ছেড়ে গিয়েছিলে কেন?"
"আরিফ আজ থেকে এক বছর আগে আমি যখন চলে গিয়েছিলাম তখন তোমাকে আমি একটা বই দিয়েছিলাম মনে আছে?"
"থাকবে না কেন?আমার বেডের পাসের টেবিলে আছে বইটা"
"ওটা বের করো।"
টেবিল হাতরে বইটা বের করলো আরিফ।বইটা হাতে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল "বের করেছি,এবার?"
"বইটার ৩২০,৩২১,৩২২,৩২৩,৩২৫ নম্বর পেজ গুলো দেখো।"
তারাহুরো করে আরিফ বইটা খুলে পেজ গুলো দেখলো।খেয়াল করে দেখলো তিনটা পেজ এ প্রায় ৪০ টা শব্দ পেন্সিল দিয়ে হাল্কা করে মার্কা করা।
ফোনে কথা ভেসে এলো "আরিফ তোমার অনেক শখ ছিলো ডিসাইফার এবং এম্বিগ্রাম নিয়ে গবেষনা করার।তোমার কাছ থেকে শিখেই একটা জিনিস দিয়েছিলাম তোমাকে।দেখি ডিসাইফ করতে পারো কিনা"

আরিফ ফোন লাউডস্পিকারে দিলো।একটা নোটপ্যাড টেনে নিয়ে শব্দগুলো লিখতে লাগলো।ডার্কার মেথডে মিলাতে না পেরে এ্যাম্বিগ্রাম এর মেথড এ ট্রাই করলো।করতেই অর্থ বের হয়ে আসতে লাগলো।সব গুলো শব্দ মিলে বাক্যটা দাড়ায়

-আমি চলে যাচ্ছি,আমি চাইনা আমার সল্প সময়ের জীবন কে তোমার জীবনের সাথে যুক্ত করে তোমাকে কষ্ট দিতে।যদি ভালো হয়ে ফিরে আস্তে পারি নিজেই আমি তোমার কাছে আসবো।নাহলে হারিয়ে যাবো অনন্ত্য মহাকালে

আরিফ লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল
"এসবের মানে কি হৃদিতা?কি হয়েছিলো তোমার?"

"একটু আগে বলেছিলাম না জিজ্ঞেস করো না জবাব দেবো না?"

"হ্যাঁ বলেছিলে"

"আরিফ তুমি কি আমাকে এখনো ভালোবাসো?"

"কি মনে হয়?"

হাসির শব্দ শোনা গেলো।
"আমি জানি তুমি আমাকে এখনো ভালোবাসো।তুমি আমাকে কোন দিন তোমার মন থেকে বিদায় দিতে পারবে না আরিফ।কারণ আমাদের ভালো বাসা সত্য ছিলো"

"আর তুমি?"

"মাঝরাতে তোমাকে ফোন দিয়ে কথা বলছি।এক বছর আগে দেয়া একটা এ্যম্বিগ্রাম দেখিয়েছি।সেটা তুমি ডিসাইফ ও করেছো।তারপর ও জিজ্ঞেস করছো আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা?"

"আচ্ছা বুঝলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো।কিন্তু হৃদিতা একটা কথা আছে মাঝখানে।এক বছর আগে এক বিকেলে তুমি টিএসসি তে আমাকে বলেছিলে তোমাকে ভুলে যেতে,তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে,যোগাযোগ না করতে।একটা বই দিয়ে তুমি আমার লাইফ থেকে চলে গিয়েছিলে।আজ এক বছর পর মাঝরাতে আমাকে ফোন দিয়ে বলছো তুমি আমাকে ভালোবাসো,আমার হতে চাও,একটা অ্যাম্বিগ্রাম ও দেখলে এক বছর আগের।তুমি আমার জীবনে ফিরে আসতে চাও।২৯ মিনিটের ফোন আলাপে এতো কিছু হজম করতে একটু কষ্ট হছে আমার।যে কারো হবে।"

"খুবই স্বাভাবিক আরিফ।তোমার বিশ্বাস না হওয়ার কথা।কি করলে বিশ্বাস করবে তুমি?"

"কাল সকালে আমার অফিস আছে।আমি ১২টায় একটা মিনি ব্রেক এ বের হবো।তুমি টিএসসির সেই খানে আসবে যেখানে তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে। গায়ে থাকবে একটা কালো শাড়ি,আমার প্রিয় রং এর। আসবে?"

"আমি আসবো আরিফ,আমি আসবো"

"তাহলে সেখানেই তোমার সাথে দেখা হবে আমার,সেই পর্যন্ত ভালো থেকো।"

"তুমিও"

ফোন রেখে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলো আরিফ।এ কি হচ্ছে?এব বছর পর?হৃদিতা?না কি এতোক্ষন যে হলো সব আমার হ্যালুসিনেশন? নোটপ্যাডের দিকে তাকালো।সেখানে লেখাগুলো এখনো দেখা যাচ্ছে।আরিফ কি মনে করে ফোনে এর ইনকামিং নম্বর টা চেক করে সেভ করে রাখলো।তারপর বই এর সব পেজ এবং নোটপ্যাডের সব লেখার ছবি তুলে রাখলো ফোনে।হ্যালুসিনেশন হলে এসব ছবি সকালে পাওয়া যাবে না।

বেশ সকালে একটা ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ঘুম থেকে উঠলো আরিফ।মনটা আজ অনেক ভালো।সত্যই যদি হৃদিতা ফিরে আসে তাহলে আরিফের জীবনের কাছে আর তেমন কোন চাহিদা নেই।

রেডি হয়ে অফিসে গেলো আরিফ।কাজ এ ঠিক মতো মন বসাতে পারছে না।সময় যতো আগাচ্ছে আরিফের মন তত অশান্ত হচ্ছে।সকালের সেই ফুরফুরে মেজাজ আর নেই।এর মধ্যে একটা গোটা পেজ প্রোগ্রামিং করতে গিইয়ে ৭০ জায়গায় ভুল করেছে।পাশের কিউবিকল এ বসা সবুজ ১৫ বার তাকে বলে দিয়েছে যে কোডিং এ ভুল আছে।আরিফ কিছুতেই মন বসাতে পারছে না।১১ টা বাজতেই আরিফ সবুজ কে ডেকে কাজ বুঝিয়েদিয়ে দৌড় দিলো,নিচে এসে নিজের বাইকে চেপে রওনা দিলো টি এস সির উদ্দেশ্যে।পথে হৃদিতার জন্য কিছু গিফট কিনলো।নিজের ব্যবহার এ আরিফ নিজেই অবাক।তার মন বলেছে হৃদিতা ফিরে আসছে।বুদ্ধি বলছে অফ সাইডের বল দেখে শুনে খেলতে হয় বন্ধু।আরিফ নিজের ভেতরে কনফিউশন কে চাপা দিয়ে সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যান এর গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
একটু পর আরিফ একটা সিগারেট ধরালো।১২ টা বাজতে এখনো ১৫ মিনিট বাকি।হৃদিতা সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না।তাই ওর সামনে কখনো সিগারেট ধরাতো না আরিফ।কিন্তু ও কেমন করে যেন বুঝ যেতো যে আরিফ সিগারেট খেয়েছে।বকা দিতো অনেক।আজ সেসব কথা মনে পরতেই আপন মনে হেসে উঠলো আরিফ।যাই হোক হৃদিতার আসতে এখনো বেশ কিছু সময় আছে।এর মধ্যে দুইটা সিগারেট অন্তত খাওয়া যাবে।প্রথমটা ধরিয়ে কেবল চারটা টান দিয়েছে আরিফ,পেছন থেকে আওয়াজ ভেসে এলো?
"তুমি এখনো সিগারেট খাওয়া ছাড়োনি?" আরিফ হেসে ফেলল।পেছন না ফিরেই আগে সিগারেট তা ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিলো।তারপর পেছনে ফিরলো।দাড়িয়ে আছে হৃদিতা। আরিফের হৃদিতা.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন