শুক্রবার, ২ মার্চ, ২০১২

এক দুপুরের ভালবাসা


এক দুপুরের ভালবাসা

সকাল সাতটা বাজেএই সময় কে এল ! অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে শব্দ বের হয় মিলাদের পুরনো সরকারি কোয়ার্টারের বেল থেকে বেলের শব্দে মিলার ঘুম ভেঙ্গে গেলমিলার মা ততক্ষণে দরজা খুলেছেমিলা খাটে উঠে বসতেই নীলা ঢুকল ওদের ঘরেঘরটা ওদের তিন বোনেরমিলা, নীলা আর ইলা

মিলা বড় বোনবিয়ে হয়েছে আজ চার বছর ভালবাসার বিয়ে মিলা আর ফরহাদের ওদের গভীর প্রেম অনেকের কাছেই ঈর্ষনীয় ছিলখুব বেশী ভালবেসেছিল মিলা ফরহাদকেমধ্যবিত্ত পরিবারে প্রেমের বিয়ে মানে একশ একটা বাধাতবু সব কিছু পেরিয়ে তারা এক হতে পেরেছিল মিলার সাহসের কারনেসবকিছু ঠিকঠাক ছিলকিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু রূপ পালটাতে থাকেকোটিপতির ছেলে ফরহাদ বিয়ে করেছে মধ্যবিত্ত ঘরের খুব সাধারন মেয়ে মিলাকেফরহাদের মা কি করে তা মেনে নেয় ! ছেলের মুখের দিকে চেয়ে মিলাকে ঘরে তুললেও তিনি নানা রকম ঝামেলা করতে লাগলেন ফরহাদ আর মিলার সম্পর্কে চিড় ধরানোর জন্যমা ভক্ত ফরহাদের কাছে মনে হত , মিলা চাইলেই পারে তার মায়ের সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলতেমিলা কিছুতেই শাশুরির আসল চেহারাটা ফরহাদের কাছে তুলে ধরতে পারেনিতাছাড়া সে নিজেও চায়নি তার কারনে মা ছেলের সম্পর্ক খারাপ হোকতাই যতই দিন যেতে লাগলো , ফরহাদ মিলাকে শুধুই ভুল বুঝতে লাগলো

একদিন ফরহাদ মায়ের কথায় কান দিয়ে খুব বেশী জঘন্য ব্যাবহার করে বসলো মিলার সাথেআর মিলাও ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলআজ দু মাস ধরে মিলা বাবার বাড়িতেফরহাদ একবারও তাকে নিতে আসেনিতবু মিলা জানে ফরহাদ বেশীদিন ওকে ছেড়ে থাকতে পারবেনাশীঘ্রই ওকে ফিরিয়ে নিতে আসবে    

সকাল বেলা বেল বাজতে মিলা তাই চমকে উঠে বসেছিলএক পলকের জন্য তার মনে হয়েছিল,ফরহাদ নয়তো! একটা সুন্দর স্বপ্নও দেখছিল মিলাসে আর ফরহাদ বুড়িগঙ্গার তীরে কাশবন ধরে হেঁটে যাচ্ছেওই জায়গাটায় প্রায়ই ওকে নিয়ে যেত ফরহাদওদের খুব পছন্দের জায়গাকিন্তু ফরহাদ আসেনি, এসেছে নীলানীলা মেজ বোনওদের ভার্সিটি থেকে পিকনিকে গিয়েছিল সিলেটে, পাঁচ দিনের জন্যকিন্তু আজ তো সবে মাত্র তিন দিন হলনীলা ফিরে এলো যে!

 “কিরে নিলু, তোর পিকনিক কি তিন দিনেই শেষ হয়ে গেল নাকি ?” হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল মিলা
না আপাআমার শরীরটা কেন যেন ভাল লাগছিলনা তাই পিকনিক ছেড়ে চলে এসেছি মিনুর সাথে এসেছি,একা আসিনিনীলার কণ্ঠ কেমন যেন চাপা চাপা
অমা,সেকি! মায়ের সাথে তো এই পিকনিক যাওয়া নিয়ে কত ঝগড়া করলিরীতিমত যুদ্ধ করে গেলিআর আজই ফিরে এলি! শরীর বেশী খারাপ নাকি রে ?” নীলার কপালে হাত রাখল মিলাজ্বর নেইবরং বেশী ঠাণ্ডামিলা চিন্তিত মুখে দেখল নীলাকেকেমন যেন উদাসীন হয়ে আছেআনন্দ করতে গিয়ে উল্টো মনমরা হয়ে ফিরল মেয়েটা
নিলু, বন্ধু বান্ধব কারো সাথে কিছু হয়নি তো ? ”     

চমকে উঠল নীলা, “না আপাযাহ, কিযে বলনা আমি যাই,গোসল করে আসিখিদে লেগেছে খুবমাকে ভাত দিতে বল

নীলা চলে যেতেই ইলা ঢুকল ঘরেইলা হল ওদের ছোট বোনইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পরেকিন্তু স্বভাব চরিত্র এখনো বাচ্চাদের মতঘরে ঢুকেই লাফ দিয়ে খাটে উঠে মিলাকে জাপটে ধরল
আপু,তুই কখন উঠেছিস...
এই তোর লজ্জা করেনা ? এত বড় বোনকে তুই তুই করে ডাকিসসাত সকালে কই গিয়েছিলি ?”

ইলা কথা এড়িয়ে বলল, “নিলু গাধীটা নাকি ফিরে এসেছে ? হিহি,খুব ভাল হয়েছে মনে তো হচ্ছিল পিকনিকে না গেলে ও মরেই যাবে এখন গিয়ে মরলহা হা...হেসে গড়িয়ে পরল ইলাইলা আসলে গিয়েছিল ওদের বাসার ছাদেছাদে খুবই ছোট্ট টিনের একটা চিলেকোঠার ঘর আছেসেখানে একজন থাকেনাম মাহবুবইলাদের গ্রামের বাড়ির দূর সম্পর্কের আত্মীয়ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে এখানে পড়তে এসেছেএই শহরে আর কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে ওদের এই টানাটানির সংসারে বাড়তি বোঝা হিসেবে ঠাই হল এই চিলেকোঠার খুপরিতে মাহবুবকে প্রথম দেখেই তার সামনেই হাসতে হাসতে খুন হয়েছিল ইলামোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর বড় গোল গোল চোখ আর তেল চুপচুপে চুল সিথি করে আঁচড়ানো চেহারাটাও একদম গোবেচারাএরপর থেকে ইলার নিত্যদিনের মজায় যুক্ত হল মাহবুবউঠতে বসতে তাকে অপদস্ত করে ছাড়ে ইলা

মাহবুব ভাই, আপনার চেহারাটা কে সহজ বাংলায় কি বল জানেন ? ম দ ন , মদনহাহাহা“ “আপনি এমন নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটেন কেন মাহবুব ভাই? এমনিতেই তো কানাবাবা, কোনদিন যে উশটা খেয়ে পরবেন কে জানে

এত পড়াশোনা করে লাভ নাই মাহবুব ভাইআপনার মত বলদের কপালে বউ জুটবেনা কনদিন,বুঝলেন ? হিহিহিসে কি হাসি ইলারওর হাসির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মাহবুবকিছুই বলতে পারেনা
আরেকদিন তো ছাদে গিয়ে জানালা দিয়ে মাহবুবের পড়ার টেবিলে তেলাপোকা ছেড়ে দিলমাহবুব ইলার কর্মকাণ্ড কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা তবে একটা জিনিস সে খুব স্পষ্টই  বুঝেছেইলা মেয়েটা তার প্রেমে পড়েছে যেমন তেমন পড়া না, ভাল মতই পড়েছেএমন ভাবে পড়েছে যে ওঠাটা খুব কঠিন একদিন সন্ধ্যা বেলা মাহবুব ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখে ইলা তার জানালায় দাঁড়িয়ে হুহু করে কাঁদছেতাকে চোখ মেলতে দেখেই দৌড়ে পালালযে কোন বাহানায় সে সারাক্ষণ ছাদে ঘুরঘুর করেসেটা যে মাহবুবের জন্য তা মাহবুব যানে ইলার ব্যাপারটা নিয়ে মাহবুব খুব চিন্তিত ছিলঘরে জানাজানি হলে একটা কেলেঙ্কারি হবেতার মত গরীব আশ্রয়ী ছেলের ভালবাসা সাজেনাভালবাসা তাদের জন্য পাপ তাকে যেভাবেই হোক ইলার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবেসেই ব্যবস্থাও সে ইতিমধ্যে করে ফেলেছে

.........................................................................................................................................................
 সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে মিলার আজকে সারাদিন কেটেছে শুধু অপেক্ষায়মিলা ধরেই নিয়েছিল আজকে ফরহাদ আসবেইআজকে একটা বিশেষ দিনঅভিমান করে যতই থাকুক , আজ মিলার অভিমান ভাঙাতে আসবেই সেমিলা তো সেই কবেই ফিরে যেতে চেয়েছিলসে শুধু অপেক্ষা করে আছে কবে ফরহাদ নিজে এসে তাকে নিয়ে যাবে সেদিনের অপেক্ষাতেই মিলা আজো ফিরে যায়নি সারাটাদিন সবার সামনে খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে মিলাতবু ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠেছেপায়ের আওয়াজ পেলেও মনে হয়েছে ফরহাদ এসেছেসন্ধার সময় যখন দরজায় বেল বাজল , দৌড়ে গিয়েছিল মিলানাহ, ফরহাদ আসেনিপোষ্টম্যান একটা খাম দিয়ে গেল খামের ভিতর ছিল ডিভোর্স লেটারফরহাদ পাঠিয়েছেসাথে একটা ছোট চিরকুট তাতে লেখা , “মিলা,তোমার সাথে এম্নিতেও আর থাকতে পারছিলাম না আমিভালই হয়েছে তুমি নিজ থেকে চলে গিয়েছতারপরও আলাদা হবার আনুষ্ঠানিকতাও সেরে নেয়া দরকারডিভোর্স লেটার পাঠালাম সাইন করে দিয়োমিলা কিছুই করলনা কাউকে কিছু বললও নাতার বিশ্বাস করতে খুব বেশী কষ্ট হচ্ছেকিন্তু ডিভোর্স লেটারে সাইনটা ফরহাদেরই সাইনের নীচে তারিখটার দিকে চোখ গেলআজ একটা বিশেষ দিনআজ তাদের বিবাহ বার্ষিকীসাইন করার সময় ফরহাদের কি তারিখটা মনে পরেনি !

 ............................................................................................................................................................

সেই সন্ধ্যা থেকে বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে নীলাসবাইকে বলেছে তার নাকি মাথা ব্যথাঅন্ধকার বলে দেখা যাচ্ছেনা কিন্তু চোখের পানিতে নীলার বালিশ ভিজে একাকার হয়ে গেছেনীলার নিজেরই নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে এত বড় ভুল সে করল কেমন করে ! ফাহিম নীলার বয়ফ্রেন্ডওরা একসাথেই পরে এবং প্রেমের প্রায় এক বছর হতে চললখুব গোপনে কাজটা করেছে নীলা যেন বাসার কেউ ঘুনাক্ষরেও টের না পায়সিলেটে ওদের সাথে ফাহিমও ছিলফাহিমের সাথে কিছুদিন থাকতে পারবে সেই জন্যই এত ঝামেলা করে সিলেট গিয়েছে সে অথচ ফাহিমের জন্যই তো এত বড় ভুল করে ফেলল নীলাভুল তো নয়, এ যে পাপ ! সারা শরীর কেঁপে উঠল নীলারঅনেক বড় পাপ করে ফেলেছে সেএই পাপ ধোয়া যায়না দু ঘণ্টা ধরে গোসল করে জ্বর আনিয়ে ফেলেছে , তবু যেন শরীর থেকে পাপ যায়নি অপবিত্র শরীর পবিত্র হবেনা আর কোনদিনভালবাসার মোহে ভেসে গিয়ে এ কি করে বসল সে? ফাহিমের হাতে এভাবে নিজেকে সঁপে দিলএকবারও তার মনে হল না সে কি করতে যাচ্ছে ? পরদিনই তাই তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে নীলাপাপের বোঝা মাথায় নিয়ে

..............................................................................................................................................................
 আজ ভরা পূর্ণিমামিলাদের পলেস্তারা খসে পড়া পুরনো বাড়িটা চাদের রুপালি আলোয় ঝলমল করছেইলা তাদের ছোট্ট বারান্দাটায় বসে আছেচাঁদের আলোয় গাছের পাতারা অপূর্ব সব নকশা সৃষ্টি করেছে বারান্দায়সেদিকে তাকিয়ে ইলার চোখ জলে ভিজে এলোসন্ধ্যায় একবার ছাদে গিয়েছিল সে দেখল মাহবুব ছাদে বেরিয়েছে

এই যে মি..মদন একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে কি করেন?”
 “তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম ইলাশান্ত স্বরে বলল মাহবুবইলার হাসি মিলিয়ে গেলমাহবুব কি বলল এটা !

আ আ আমার জন্য !ইলা কথা খুঁজে পেলনা

ইলা, তোমার একটা জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে তুমি একটু দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি মাহবুব ওর ঘরে গিয়ে সেই প্লাস্টিকের তেলাপোকাটা নিয়ে এলো, যেটা দিয়ে ইলা ওকে ভয় দেখিয়েছিল
নাও ইলাইলা কাঁপা কাঁপা হাতে নিল ওটাসে কিছুই বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে
ইলা, আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম
কেন?”
আমার হলে সিট হয়ে গেছে ইলা আমি কাল চলে যাচ্ছি , হলে উঠবো তুমি ...তুমি ভাল থেকোবলেই চট করে ওর রমে ঢুকে গেল মাহবুবওর চোখের জল ইলাকে দেখাতে চায়না সেএই অবুঝ মেয়েটাকে কখন যে এতটা ভালবাসে ফেলেছে সে নিজেও টের পায়নি কাল থেকে এই দুষ্টু মেয়েটা তাকে আর জালাতন করবেনাইলা পাথরের মত দাঁড়িয়ে ছিল ছাদেইচ্ছে হচ্ছিল তখনি ছাদ থেকে ঝাপ দেয়, অথবা ...অথবা দৌড়ে গিয়ে মাহবুবকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আপনি কোথাও যেতে পারবেনা আমি আর কোনদিন আপনাকে জালাবনা,বিরক্ত করবনাকিন্তু আপনাকে আমি কোথাও যেতে দিবনা,কোথাওনাএসব কিছুই করলনা ইলাচুপচাপ নীচে এসে বারান্দায় বসে রইল

.......................................................................................................................................... ইলার চোখ কিছুতেই বাঁধ মানছেনা অনবরত কেবল জল গড়াচ্ছেকান্নার বেগে ইলা কেঁপে কেঁপে উঠছেনীলা কখন যে বারান্দায় এসে দাড়িয়েছে ইলা দেখেইনি নীলা আসতে করে ইলার কাধে হাত রাখলইলা চমকে উঠে নীলাকে দেখেই ওকে জড়িয়ে ধরলনীলাও কাঁদতে লাগলো ইলার সাথে সাথেঅথচ দু জনের কেউই জানেনা একজন এরেকজনের দুঃখতবু তারা একসাথে কাঁদছেমিলা বারান্দায় এসে দেখে দুবোন জড়াজড়ি করে কান্না করছে

নিলু,ইলু......কি হয়েছে তোদের ? ”
ইলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল , “আপু রে, ভালবাসায় কি খুব কষ্ট রে আপু ?”
নীলাও কাঁদতে লাগলো, “বলনা আপা,ভালবাসালে কেন এত কষ্ট পেতে হয় ?”
মিলা দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলকি জবাব দিবে সে !

ভালবাসা এই চাঁদের আলোর মত রেদেখ কত সুন্দর পাতার নকশাকিন্তু ধরতে গেলে নেই পুরোটাই মায়া বলেই আর কান্না সামলাতে পারলনা সেনীলা আর ইলাকে আরও শক্ত করে বুকে চেপে ধরলএই অপারথিব মায়াবি জ্যোৎস্না রাত্রিতে তিনটি দুঃখী মেয়ে কি যেন বুক ফাটা কষ্টে কেঁদেই চললতাদের ঘিরে চাঁদের আলোয় গাছের পাতার কি অপূর্ব নকশা বাতাসে কাঁপছে

এক দুপুরের ভালবাসা তেমন কিছুই নয়
আরেক দুপুর এলেই তাকে ভুলে যেতে হয়
এক দুপুরের ভালবাসায় দুটি চোখে জল
সেই জলে ডুব দিয়ে দেখ পাবেনা অতল
সেই অতলের মাঝে তুমি হবে নিরুদ্দেশ
একদুপুরের ভালবাসা আরেক দুপুরেই শেষ

মাধবীলতা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন