মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১২

''বৃষ্টি...''


~~~ ''বৃষ্টি...'' ~~~

বৃষ্টি কার না ভাল লাগে... তবে কিছু মানুষ আছে যারা বৃষ্টি দেখলে বা বৃষ্টির শব্দ শুনলেই অন্য এক জগতে চলে যায়... নিপাকে তাদেরই দলের ধরা যায়... ঘণ্টা কলেজ করে বাসায় এসেছে মাত্র... বাসায় ঢোকা মাত্রই বাহিরে বৃষ্টি শুরু হল। আফসোসের আর অন্ত রইল না...মনে মনে ভাবল- আর মিনিট দেরিতে আসলেই ভিজতে পারতাম...বৃষ্টি হলে কাওকে পরোয়া করত না নিপা... কতবার ঠাণ্ডা লাগা সত্ত্বেও কাওকে না জানিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছে হিসেব নেই... কতবার বৃষ্টিতে কলেজের বই-খাতা ভিজে একাকার... তাও কোন দুঃখ নেই... সব দুঃখ যেন বৃষ্টিই ধুয়ে নিয়ে যায়... আজও সব কিছু ভুলে ছাদে দৌড় দিল... ছাদে কেও নেই... নিপা মনের আনন্দে ছাদের এপাশ থেকে অপাশ দৌড়াদৌড়ি করে ভিজতে লাগল...

এদিকে আবির ফোন করতে করতে অস্থির..... বৃষ্টি দেখা মাত্রই আবির বুঝেছে যে নিপা আর বাসায় নেই... কতবার বুঝিয়েছে নিপাকে... মেয়েটা কেমন জানি! নিজে যা বুঝবে তাই ঠিক... কারও কথা শুনবে না... বৃষ্টি আর আইসক্রিম... এদুটি জিনিসের প্রতি তার সীমাহীন আকর্ষণ... নিপাকে যেদিন আবির প্রপস করে সেদিনের কথা......

অন্য সবার মত আবিরও বিশেষ কোন দিনেরই অপেক্ষায় ছিল... সব শেষে ঠিক করল- ১৪ই ফেব্রুয়ারীতেই নিপাকে ওর মনের সব কথা বলে দিবে। বাজার ঘুরে সবচেয়ে তাজা গোলাপ কিনল... নিপা একদিন বলেছিল, “তোমাকে পাঞ্জাবি পড়লে খুব সুন্দর লাগে”... তাই আবির আজ পাঞ্জাবি পড়েই নিপার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে... আবির ভেবেছিল নিপাকে শাড়ি পড়তে বলবে... কিন্তু ভয়েতে আর বলতে পারেনি... পরে দেখা যায় নিপা নিজ থেকেই শাড়ি পড়ে আসে...
১৪ই ফেব্রুয়ারী কাওকে গোলাপ দেয়ার পর মুখে খুব একটা কথা বলার দরকার পড়েনা...বুঝাই যায় সে কি বলতে চাচ্ছে... কিন্তু নিপাও নাছোড়বান্দা... কবে থেকে পছন্দ করো... আগে বল নাই কেন.... সব কথা তখনই বলতে হবে...সব শেষে একটা কন্ডিশন... সেটা হল আইসক্রিম খেতে মানা করা যাবেনা... বৃষ্টিতে ভিজতে বাধা দেয়া যাবেনা... আবির তখন সব মেনে নেয়... কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এই কন্ডিশনটাই তাকে কি পরিমান জ্বালিয়ে মারছে...


নিপা ছাদ থেকে ফিরতে ফিরতে আবিরের ৫০-৬০ বার ফোন করা শেষ... কিছু বলতেও পারেনা... নিপা নিজে নিজের মত চললেও আবিরকে ঠিকই সব দিক থেকে নজরে রাখত... যেই ছেলে আগে ঘুম থেকে উঠতে একটা বেনসন আর ঘুমাতে যেতে একটা বেনসন খেত, সে এখন সিগারেট নিজ হাতেই ধরে না...নিপা জানত আবিরের খেয়াল ওকেই রাখতে হবে...একটা ছেলে একা একা ঢাকায় মেসে থাকে, সে যে নিজের যত্ন নিতে পারবেনা সেটা বুঝাই যায়, নিপা সুযোগ পেলেই আলাদা করে খাবার রান্না করে আবিরকে ফোন করে খাবার নিয়ে যেতে বলে... সব কিছু খুব সুন্দর ভাবেই চলতে থাকে...

আবির বৃষ্টিকে সবচেয়ে অপছন্দ করত... এর কারন বৃষ্টি হলেই নিপা ওকে ভুলে যায়... চলে যায় নতুন দেশে... নিপার এইচ এস সি পরীক্ষার পরপরই আসে প্রথম ধাক্কা... আবিরের ব্যপারে সব কিছু জেনে যায় নিপার মা-বাবা...নিপার বাবার এক কথা... প্রেমের বিয়ে মেনে নেয়াই যাবেনা... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল আবির...কিন্তু এটাও ওর বাবাকে মানাতে পারে নাই... চাঁদের দেশের ছেলের সাথেও প্রেমের বিয়ে তিনি মেনে নিবেন না। ছোট বেলা থেকে বাবাকে দেখে আসছে নিপা... তাই সে নিশ্চিতই হয়ে গেল যে আবিরকে সে কখনই পাবে না... নিপা আবিরকে বলে পালিয়ে বিয়ে করতে কিন্তু সেটা করতেও আবির রাজি না...

আবির ওকে বলে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেই নিপার বাবার কাছে যাবে... যা করার তখনই করবে... কিন্তু বিধাতা যেন ওদের প্রতি মুচকি হাসলেন... নিপার বাবা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেললেন...... এক বার জিজ্ঞেসও করলেন না... হঠা একদিন বললেন... তৈরি হয়ে নে... তোকে আজ দেখতে আসবে... নিপা আবিরকে এসব কথা বললে আবির কেন জানি শুনতে চাইত না... খুব সহজ ভাষায় বলতোকিচ্ছু হবে না...”

বিয়ের কথাবার্তা খুব দ্রুতই ঠিক হতে থাকে... নিপা আবিরের সাড়া না পাওয়ায় বলেই বসে... হয় পালিয়ে আমাকে বিয়ে করো না হয় আমাকে ছেড়ে দাও... এভাবে অনেক জোর করে নিপা আবিরকে রাজি করায়। সেপ্টেম্বর মাসের কোন একটা তারিখ তারা ঠিক করে বিয়ে করবে বলে... বিয়েটা অনেকটা আবিরের দ্বিমতেই হচ্ছিল... একা মেসে থাকত... নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না... তবুও নিপা ওকে জোর করে রাজি করায়... রাজি না হয়ে উপায়ও ছিল না আবিরের...

আবির আর নিপার সকাল ১১ টায় দেখা করার কথা... সকাল টার দিকেই নিপা তার বাসা থেকে চিরদিনের জন্য চলে এসেছে...আসার সময় কাওকে কিছু বলেনি। সিনেমায় যেমন চিঠি রেখে আসতে দেখা যায় তেমন চিঠিও লিখে রেখে আসেনি... ওর ঘরে গেলে এমনিতেই সবাই বুঝে যাবে যে নিপা আর আসবেনা... বাড়ি ছাড়তে নিপার খুব কষ্ট হচ্ছিল... ভাবতেই অবাক লাগছিল যে আর কখনও এই বাড়ির ছাদে বৃষ্টিতে ভিজবেনা...চোখ থেকে বৃষ্টির মতই কয়েক ফোঁটা জল ঝরেছিল...

১১ টায় দেখা করার কথা... ১২টার দিকেও আবিরেই কোন দেখা নেই। নিপা ফোন করল... আবির বলে আর ১০ মিনিট... ১০ মিনিটের জায়গায় ২০ মিনিট হয়ে গেলে নিপা আবার ফোন দেয়... কিন্তু ফোন আর বাজে না... বন্ধ করা... ৩০ মিনিটের মাঝে আরও কতশ বার যে ফোন দেয় তার হিসেব নেই... নিপা ভাবে আবির মনে হয় কোন ঝামেলায় পড়েছে... কারন আবির কখনও ফোন বন্ধ করে না। ক্লাসেও না... নিপা এর পরে আবিরের মেসের উদ্দেশে রওনা দেয়... মেসে গিয়ে শোনে গতকালই আবির মেস ছেড়ে দিয়েছে... কেও নতুন কোন ঠিকানাও দেয়না...নিপার বাকিটুকু আর বুঝতে বাকি থাকে না। এত দৌড়াদৌড়ি করতে করতে বিকেল হয়ে যায়... প্রথম কদিন ফ্রেন্ড এর বাসায় কাটায়... পরে বুঝতে পারে যে ফ্রেন্ড এর ফ্যামিলির কাছে সে একটা বোঝা... শেষমেশ সে আবার বাড়িতে ফিরে যায়, তার বাড়িতে...

বাড়িতে কেও তার সাথে কথা বলে না... তার বাবার ঘরে তার ঢোকা নিষেধ। পদে পদে বাড়িতে তাকে কথা শুনতে হয়... একটা মানুষও নেই যে তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে... ভাবি, মা সবাই তার সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে... এত কষ্ট আর সহ্য হয়না... একদিন আত্মহত্যা করার জন্য এক গাদা ওষুধ খেয়েই ফেলে... কিন্তু ভাগ্য আবার যেন মুচকি হাসল... সবাই তাকে বাচিয়ে তুলে...
আজব দুনিয়া! যেই মানুষগুলো পদে পদে কষ্ট দিচ্ছে... যাদের কষ্ট সইতে না পেরেই এই কাজ, তারাই আবার হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করে সুস্থ করে তুলে...

বাবার জন্য তার কষ্ট হয়... বাবা তার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন...বাবা আর এখন বেঁচে নেই...
মারা যাওয়ার আগে নিপার মাকে বলেছিলেন... তোমার একটা মেয়ে বাদে সব ছেলেমেয়েকেই মানুষ করে গেলাম......

নিপা এখন একা... কষ্ট দেয়ারও কেও নেই...আনন্দ দেয়ারও কেও নেই... বর্ষাকালে বৃষ্টিই তাকে সঙ্গ দেয়...তাই এখন সে শুধুই আকাশের পানে চেয়ে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে... এখন আর বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরলে মোবাইলে একগাদা মিসকল দেখা যায়না...কেও তাকে ঘনঘন বৃষ্টিতে ভিজতেও মানা করে না...
সবচেয়ে অবাক করা কথা... তার এখন আর আইসক্রিম খেতে ভাল লাগেনা
...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন