শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১২

"তুই কি জানিস না ?"


"তুই কি জানিস না ?"
-By Debasree Piya
পড়ন্ত বিকেলে চারুকলার সামনে থেকে জুঁইকে একগোছা চুড়ি কিনে দেয় রাহুল জুঁইয়ের পরনে হলুদ শাড়ি, হাতে লাল চুড়ি গালে হালকা মিষ্টি রোদ মেখে হাত ধরাধরি করে হেঁটে এগিয়ে চলে ওরা স্মৃতি ভাস্কর্য , টিএসসি পেরিয়ে বইমেলার মূল প্রাঙ্গনে ঢোকে ওরা দূরে কোথা থেকে মাইকে গান ভেসে আসছে তরুন তরুনীদের কন্ঠে
"আজ হোক না রং ফ্যাকাশে
তোমার আমার আকাশে
চাঁদের হাসি যত- হোক না ক্লান্ত
বৃষ্টি নামুক নাইবা নামুক ঝড় উঠুক
নাইবা উঠুক আজ বসন্ত "
রাহুল সেই ভেসে আসা গানের তালে মাথা দোলাচ্ছে রাহুলের এই পাগলামি আচরন দেখে ভীষন রাগ হয় জুঁই এর প্রথমে কিছু বলল না সে কিন্তু কিছুক্ষন পর রাহুলের দোলাদুলি যখন বেড়ে গেল তখন জুঁইয়ের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ -
- শোন একদম পাগলের মত মাথা দোলাবি না পোলাপান তোর দিকে তাকায়ে হাসবে
-হাসুক গা আমারে পাগল বললে তোর কি ?
-কিছুই না কিন্তু আমারে তো পাগলী ভাববে নইলে তোর মত পাগলের সাথে আছি কেন ?
-তোর কি মনে হয় তুই যে সাজ দিছিস তাতে তোরে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ মনে হইতেসে ? মোটে না। পুরা আমাদের পাড়ার আছিয়া পাগলীর মত লাগতেছে
- ফালতু কথা বলবিনা একদম তোর কেনা এই পঁচা চুড়িগুলোর জন্যই তো খেত লাগতেছে
-এহ ! কোথায় ভাবলাম তোকে আইসক্রীম খাওয়াব এখন আর কিচ্ছু খাওয়াব না
-খাওয়াস না আমি কি তোর মত পেটুক নাকি ?
রাহুল আর কোন কথা বলার প্রয়োজন মনে না করে বইয়ের স্টলের দিকে এগিয়ে গেল প্রিয় লেখকের বইয়ের সংগ্রহ দেখে রাহুল বই কেনাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাহুলের বই কেনার প্রতি তীব্র আকর্ষন দেখে জুঁই সামান্য বিরক্ত বোধ করল কিন্তু প্রকাশ করল না কিন্তু জুঁইয়ের বিরক্তির প্রতি রাহুলের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই সে আপন মনে বই বাছাইয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে বিরক্তির সীমা যখন তীব্র পর্যায়ে তখন জুঁইয়ের চোখ পড়ল স্টলের বাইরে রাস্তার ওপারে কিছুটা ভিড়ের দিকে কৌতুহলের সমাপ্তি ঘটাতে ওখান থেকে নীরবে জুঁই ওদিকটায় রওনা দিল এত ভীড়ের কারন জানতে পেরে জুঁইয়ের আনন্দ যেন আর ধরে না ! কোন এক হারবাল কোম্পানি মেহেদি লাগানোর আয়োজন করেছে মেয়েদের কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই নিজের মত নকশা পছন্দ করে নিল জুঁই দু হাতে মেহেদির নকশায় ভরে গেল
হঠাত জুঁই মাথার ওপরে ভারি কিছুর আঘাত অনুভব করে যার ফলে তার পুরো শরীরটা যেন শিরশির করে ওঠে কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাহুলের চিত্কার -
-"নির্বোধ ! তুই এখানে ! একবার বলে আসবিনা ? আমি তোকে খুঁজে মরি আর তুই ! মানুষকে টেনশনে ফেলতে খুব ভাল লাগে তাইনা ?"
রাহুলের হাতের দিকে তাকায় জুঁই বুঝতে পারে যে তিনটে মোটা বই দ্বারা আঘাত করা হয়েছে তার মাথায় মনের অজান্তেই চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে ওর গালে পড়ন্ত বিকেলের হালকা রোদ এসে পড়েছে ওর ফুটফুটে মুখে সে আভায় ওর দু ফোটা অশ্রু মুক্তোর দানার মত ঝলমল করে উঠল রাহুল জুঁইয়ের দিকে খেয়াল করে তাকাতেই মাথা থেকে রাগ আর তীব্র ক্ষোভ কেমন হঠাত করে কোথায় যেন পালিয়ে যায় জুঁইয়ের অশ্রুভরা চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি আর মায়াভরা মুখটা রাহুলের সবকিছু কেমন ওলটপালট করে দেয়
এতটা খেয়াল করে জুঁইকে কখনও দেখেনি রাহুল হঠাত একটা উড়ো হাওয়ায় জুঁইয়ের ঘনকালো চুলের সামনের অংশটুকু অশ্রুভরা চোখ দুটোকে ঢেকে ফেলল রাহুলের মনে হতে থাকে যেন স্বর্গ থেকে এক অপ্সরী নেমে এসেছে যার অপুর্ব মায়াকারা সৌন্দর্য রাহুলকে মাতাল করে তুলছে জুঁইকান্না কান্না গলায় বলে ওঠে -

-"তা বলে এত জোরে মারবি আমাকে ? জানিস কতটা লেগেছে মাথায় ? উফ !"
জুঁইয়ের কাঁদো কাঁদো আওয়াজ রাহুলকে তার স্বপ্নীল কল্পনা থেকে ফিরিয়ে আনে আর তার চোখ পড়ে যায় জুঁইয়ের হাতে
-কি লাগিয়েছিস এসব হাতে ? ইয়াক !
-এটা মেহেদী তুই বুঝবি কি এসবের ?
-কি বাজে গন্ধ ! এখন কি এই গোবরের মত জিনিসটা হাতে লাগিয়ে ঘুরবি ?
-এই শোন ! এটা গোবর না এটা মেহেদী ঘন্টা খানেক পর ধুয়ে ফেললে হাতে সুন্দর রঙিন
নকশা তৈরি করে
-এহে ! এক ঘন্টা তুই এই বাজে গন্ধ ওয়ালা জিনিস নিয়ে ঘুরবি ?
-এটা মোটে বাজে গন্ধ ওয়ালা জিনিস না এটা মেহেদী মেহেদী মেহেদী হঠাত রাহুলের ফোনটা বেজে ওঠে ফোনটা নিয়ে কথা বলার জন্য একটু দূরে সরে যায় রাহুল কি কথা বলছে ,কার সাথে কথা বলছে তা জানতে জুঁই একটু এগিয়ে আসে কিন্তু রাহুল তাকে দেখতে পেয়ে আরো দূরে সরে যায়। এবার ভীষন রাগ হয় জুঁইয়ের রাগে গমগম করতে করতে রিক্সা ঠিক করতে রওনা দেয় জুঁই খোপার গোলাপটা পড়ে যায় মাটিতে
-মামা যাবেন ? ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেইট
রিক্সায় উঠে পড়ে জুঁই পিছন থেকে রাহুলের গলা শুনতে পায় সে -
-এই জুঁই কই যাস ?আরে ! হলোটা কি ? দাঁড়া !কই যাইতেছিস তুই ? জুঁইয়ের রিক্সা চলতে শুরু করে তার হলের দিকে আর রাহুলের গলাটা ধীরে ধীরে আবছা হতে হতে একসময় বাতাসের সাথে মিলিয়ে যায় খুব রাগ হতে থাকে জুঁইয়ের

"কার সাথে কথা বলছিল রাহুল? আমাকে দেখে ওদিকটায় সরে গেল কেন ? কি ওর গার্লফ্রেণ্ডের সাথে কথা বলছিল ! হুহ ! এরকম একটা পাগলকে কোন মেয়ে ভালবাসবে শুনি ? আচ্ছা আমার এত রাগ হচ্ছে কেন ?" এসব ভাবতে ভাবতেই জুঁইয়ের মনে পড়ে যায় রাহুলের সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা গত পহেলা বৈশাখে কলেজ ফ্রেণ্ড মিতার সাথে টি,এস,সি তে আড্ডা দিচ্ছিল সে পরনে ছিল লাল পেড়ে সাদা শাড়ি আর খোঁপাতে বেলী ফুলের মালা। হঠাত মিতা একটি ছেলেকে দেখেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে
-"কিরে রাহুল ! তুই এখানে ? একাই নাকি ?" রাহুল নামের ছেলেটির জবাব -"হুম একাই। এতক্ষন অবশ্য সৈকত ছিল আবার কোথায় যেন গেল !" রাহুল মিতার সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে Physics ডিপার্টমেন্টের Student সে অতি সাধারন,উসকোখুশকো চুল ,শ্যামলা বর্নের চশমা পড়া রাহুলের সাথে সেদিনই প্রথম আলাপ হয় জুঁই এর তারপর বন্ধুত্বটা ফেইসবুকের এ্যাড এক্সেপ্ট থেকে শুরু করে পৌঁছে যায় জুঁইয়ের মেডিকেল কলেজ চত্বরে ধীরে ধীরে সেখান থেকে পৌঁছে যায় ধানমণ্ডি লেক , রবীন্দ্রসরোবরে যেখানে একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে হারিয়ে যায় স্বপ্নের জগতে , সেখানে ওরা দুজন একে অপরের চুল টানতে ব্যস্ত কখনো বা সেটা পৌঁছে যায় বন্ধুত্বের মিষ্টি ঝগড়া মারামারিতে কেমন বন্ধুত্ব জানেনা জুঁই যে বন্ধুত্ব একদিনের নীরবতা মানেনা সারারাত ফোনে কথা বললেও যেন কথা ফুরোতে চায়না ওদের জুঁই চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজতেই রাহুলের সাদামাটা মুখটা ভেসে ওঠে জুঁইয়ের চোখের সামনে " একী ! রাহুলের মুখ কেন দেখলাম ?আচ্ছা আমার কী হয়েছে ?রাহুল ফোনে আমাকে না জানিয়ে কথা বলছিল তাতে আমার কেন এত রাগ হল ! আমি কেন এত পাগলামি করলাম ?" হঠাত জুঁইয়ের ফোনটা বেজে উঠল স্ক্রিনে রাহুলের নাম ফোনটা বন্ধ করে ফেলে সে মুহুর্তেই পন করে ফেলে সে আজ রাতে ফোনটা আর অন করবেনা ফাল্গুনের প্রথম রাত না খেয়ে না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয় সে ফোনটা অন করবে কি করবে না নিয়ে অনেকবার ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল সে ফোনটা বন্ধ রাখবে কে এই রাহুল ? কেন তার জন্য এত অনুভূতি তার ? এই প্রশ্নের উত্তর পায়না সে
একটু চোখ বুজতেই বিছানার পাশের জানালাটা থেকে ভোরের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়ল জুঁইয়ের চোখে ফোনটা অন করতে মেসেজের টোন বেজে ওঠে রাহুলের মেসেজ- "ফাইনালি ফোনটা অন করলি সারা রাতের ঘুম খেলি আমার ! আজকে যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে মনে আছে ?"
জুঁইয়ের উত্তর ,"জেনে লাভটা কি ?"
রাহুলের উত্তর , "কখনোতো কিছু জানতে চাসনি তাইতো তোর চোখের দিকে তাকাতে পারিনা আমি মনে হয় যেন সব বুঝে ফেলবি আমার মনের লুকানো সব কথা "
জুঁইয়ের ফিরতি উত্তর ."রামছাগল ! তুইকি জানিস না ? জানতে চেয়েছিস কখনো ?"
রাহুলের মেসেজ, "রামছাগল বলিসনা তোর আগেই আমি কেমন জেনে নিলাম বলতো ?
কালকে তো তোর চোখে হিংসের আগুন দেখেই জেনেছি ফোনটা তো ছিল সৈকতের আমি দূরে সরে যেতেই অমন পাগলী হয়ে গেলি যে ? হেহেহে "
জুঁইয়ের ফিরতি মেসেজ , "মিটমিট করে হাসবিনা একদম গা জ্বলে আমার "!
মেসেজগুলো পড়তেই জুঁই কেমন হতবাক হয়ে যায় কালকের পাগলামির জন্য নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হতে থাকে তার দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে সে আবার মেসেজের টোন বেজে ওঠে, "তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে চত্বরে আয়। আজ কিন্তু বসুন্ধরা সিটিতে যাব তোর অনেকদিন যাওয়ার ইচ্ছে না ?" সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হতে থাকে জুঁইয়ের
একছুটে আলমারি থেকে লাল শাড়িটা বের করে পড়ে নেয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবতে থাকে সে - "আচ্ছা , তুই কি পড়বি আজ ? তোর লাল পান্জাবিটা পড়লে বেশ হতো আর সাথে silver colour এর ঘড়িটা আমার চুলটা না হয় ছাড়াই থাক আজ চোখে কাজল আর ঠোঁটে Light gloss ছাড়া আর কিছু সাজতে পারবনা আজ না হয় খ্যাতই থাকলাম "
রাহুলের মিসকল পেয়েই নিচে নেমে পড়ে সে চত্বরে লাল পান্জাবি পড়ে আর হাতে লাল গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাহুল জুঁই হাতের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করে দেখল আজই ঘড়িটা পড়তে ভুলে গেছে রাহুল কিন্তু আজ একটু রাগ হলনা তার জুঁই এগিয়ে যেতেই রাহুল আজ প্রথম কেমন নার্ভাস হয়ে যায় হাত থেকে গোলাপটা কেড়ে নেয় জুঁই
"জানতাম তুই দিবিনা , আমাকেই নিতে হবে "
রাহুলের চোখে চোখ পড়ে যায় তার। অজানা এক আকুলতার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে জুঁই , সে দৃষ্টিতে হাজারো প্রশ্ন খুঁজে পায় রাহুল শুধু জুঁইয়ের ঠোঁট দুটো ধীরে বলে ওঠে -
"শোন আজ থেকে আমি তোকে তুমি বলে ডাকব ?" রাহুল শক্ত করে চেপে ধরল জুঁইয়ের হাতটা আজ প্রথম নয় এর আগে রাহুল বহুবার হাত ধরেছে জুঁইয়ের কিন্তু সেটা ছিল বন্ধুত্বের ছোঁয়া আজকের স্পর্শে যেন অজানা এক অনুভূতি ,কত পাওয়া না পাওয়ার সমীকরনের সমাধান রয়েছে স্পর্শে রাহুলের কাঁধে মাথা দিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে শুরু করে জুঁই আজ জুঁইয়ের দু চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে কিন্তু অশ্রু অপেক্ষার নয় , প্রাপ্তির অশ্রু।

~~~ THE END ~~~

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন