মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ভালবাসার গল্প-4

" আমার হলুদ কন্যা "
By- Mahmud Hasan

হয়তো মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি বলেই একটু রক্ষণশীল মানসিকতার ছিলাম। মফঃস্বলের স্কুল থেকে পাশ করে ঢাকায় এসে নটরডেম কলেজে ভর্তি হলাম। শহরের পাথুরে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে একটু কষ্টই হচ্ছিল। শহরের ছেলেগুলো সহজাতভাবে মেয়েদের সাথে মিশতে দেখে খুব লাগতো। অথচ আমার সাথে কোন মেয়ে কথা বললেই কেমন যেন নার্ভাস ফিল করতাম। অবশ্য মেয়েরাও আমাকে খুব একটা পাত্তা দিতো না। আমিও পাত্তা পেতে চাইতাম না। আমি ছিলাম ওদের কাছে রীতিমতো backdated... । কখনই কোন মেয়েকে তুমি বলতে পারিনি...আপনি বলেই কোনরকমে কাজ সারতাম। চুপচাপ প্রাইভেট পড়ে মেসে চলে আসতাম। এভাবে এইচএসসি লাইফটা কেটে গেল।

এইচএসসি পরীক্ষার পরে আসিফ ভাইয়ের প্ররোচনায় মাথায় ভুত চাপল IELTS করার। ফার্মগেটের একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলাম। এখানে স্পোকেন ইংলিশ আর ফনেটিক্স শিখার জন্য একসাথে গ্রুপ করে প্র্যাকটিস করতে হতো। আমাদের গ্রুপে মেয়ে বেশী থাকায় বেশ ঝামেলায় পরে যেতাম। মেয়েদের সাথে কথা শুরু হলেই আমার যেন জিহবায় কেমন গিট্টূ লেগে যেত। এর মধ্যে রুপা নামে একটা মেয়ে ছিল। হাসিখুশি,উজ্জ্বল চোখ,সুন্দরী কিন্তু অতিরিক্ত বাঁচাল টাইপের মেয়ে। আমি মেয়েদের সাথে কথা বলতে লজ্জা পাই জেনেই বোধহয় আমাকে বেশী করে লজ্জা দিত। আর মেয়েটা ছিল খুব আধুনিক আর এরোগেন্ট। এজন্যই হয়তো মেয়েটাকে আমার অসহ্য লাগতো। একবার আমাদের টিচার ইংলিশে বিয়ের কার্ড বানাতে বলল। রুপা আশ্চর্য এক কাণ্ড করলো। বরের জায়গায় আমার নাম আর কনের জায়গায় নিজের নাম দিল। টিচারসহ পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পরল। আমাকে পচিয়ে বোধ হয় অনেক মজা পেত। তবে অন্য বন্ধুরা আমাকে পচালে সে-ই সেভ করতো। এক দিন সে আমার মোবাইলে একটা মেসেজ দিল...feeling blue. ভাবলাম নতুনভাবে আমাকে পচানোর বুদ্ধি। কিন্তু সেদিনের পর রুপা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল।

IELTS করে কোন লাভ হল না। শেষপর্যন্ত ভার্সিটিতেই ভর্তি হলাম। ভালো সাবজেক্ট পেলাম না। আর রুপা ফিজিক্স পেল। কিন্তু প্রথম দিনই আমাদের ডিপার্টমেন্টে ক্লাস করতে গিয়ে ওকে দেখে আকাশ থেকে পরলাম। ও ফিজিক্স পেয়েও তা ছেড়ে soil science এ চলে এসেছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরো ক্লাসের সবাই জেনে গেল ও আমাকে পছন্দ করে। অথচ ওকে দেখলেই আমার মনে ভয় ধরে যেতো। ওর আধুনিক পোশাকআশাক ,কাট-কাট কথাবার্তা সবই আমার অপছন্দ ছিল। আমার মতো রক্ষণশীল মানসিকতার ছেলে ওর মতো ফাস্ট মেয়ের সাথে মিলবে না, এটাই স্বাভাবিক। আমার মনের কথাটা টের পেয়েই বোধ হয় রুপা আর আমাকে ঘাটাল না। তবে ওর কেমন যেন একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আগের মত আড্ডায় আসে না। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। ওর বান্ধুবীদের ধারনা নতুন কোন প্রেমে জড়িয়েছে। একটা সময় দেখলাম জিন্স ছেড়ে সালোয়ার কামিজ পরা শুরু করলো...তার কিছুদিন পর হিজাব পরা শুরু করল। এরপর বেশ কিছুদিন ভার্সিটিতেই আসলো না। তখন ভাবলাম সত্যি সত্যি বিয়ে-টিয়ে হয়ে গেছে । বুকটা কেমন ফাকা ফাকা লাগা শুরু হল। কিন্তু আমার বুকটাকে পূর্ণ করে দিয়ে দেড় মাস পর ভার্সিটিতে আসলো। দেড় মাস পর রুপাকে আগের রুপার সাথে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। শালীন পোশাক পরা নম্রভাষী রুপার চোখেমুখে যেন অদ্ভুত মায়া এসে ভর করেছে।

১লা ফাল্গুনের দিন হঠাৎ করে আমাকে ফোন দিয়ে টিএসসিতে আসতে বলল। ওইদিনের রুপাকে আমি কোনদিনই ভুলতে পারবো না। হলুদ শাড়ি আর মাথায় ফুলের খোঁপা দেয়া রুপাকে যেন ডানাকাটা পরীর মতো লাগছিল। সেই দিন রুমে ফিরে হলুদের ঘোর কাটাতে পারলাম না। যা দেখি তাতেই যেন হলুদের ছোঁয়া লেগে আছে। রাতের বেলায় মোবাইল খুলেই রুপার মেসেজ দেখে অবাক হলাম। মেসেজটায় লেখা...feeling blue…& it is true…এটা পড়েই কিছু চিন্তা না করেই উত্তর দিয়ে দিলাম...me also….ওই রাতে ওকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল। কিসের তাড়নায় ওর হোস্টেলের সামনে ছুটে গেলাম জানিনা। এতদিন ধরে দেখছি ওকে...কিন্তু ওই রাতের মত আর কোনদিন ওকে দেখতে ইচ্ছা হয়নি। সারাটা রাত ওর হলের সামনে দাড়িয়ে দেখা না পেলেও পরের দিন ওকে ভালবাসা দিবসের প্রথম ভালবাসার ফুলটা দিতে ভুল করিনি।

আমার হলুদকন্যার সাথে ভার্সিটির পরের ৩টা বছর ভালই কাটিয়েছি । আমার হলুদ কন্যার উপচেপরা ভালবাসা পেতে কতো কিছুইনা করেছি আমি। যে আমি সাইকেল চালাতে জানতাম না সেই আমি মোটরসাইকেল চালানো শিখেছি...শুধুমাত্র রুপাকে নিয়ে ঘুরব বলে...রুপা আমাকে মোটর সাইকেলের পেছনে বসে জড়িয়ে ধরবে বলে। রুপা ফাগুনের প্রথম দিন অর্থাৎ ১৩ই ফেব্রুয়ারি দিনটা খুব ভালোবাসতো। আমিও সারাটা বছর এই দিনটার অপেক্ষায় থাকতাম। ও বছরের এই দিনটায়ই শুধু সারাটা দিন হলুদ শাড়ি পরত।

২০০৮ সালের ১২ই জুন আমাদের বিয়ে হল। সুখেই কাটছিল আমাদের জীবন। এখন দুজনেই চাকরি করি। তারপরেও হাজারো ব্যস্ততার মাঝে দুজনেই পহেলা ফাগুনের দিনটা আলাদা করে রাখি। ২০১০ সালের ১৩ই জানুয়ারি আল্লাহ আমাদের কোল আলো করে একটি অ্যাঞ্জেল দিলেন। শখ করে রুপার সাথে মিলিয়ে নাম রাখলাম রুপকথা।

সবকিছু ভালই চলছিলো। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা আমার ছোট্ট সংসারটা ভেঙেই দিচ্ছিল প্রায়। কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে আমার প্রাইভেট কারকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দেয় দ্রুতগতিতে আসা একটা ট্রাক। রুপা মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায়। আর পায়ের হাড় ভেঙ্গে প্রচুর ব্লিডিং হয়। টানা ১১ দিন চট্টগ্রাম মেডিকালের আইসিইউতে অজ্ঞান ছিল। চট্টগ্রাম ভার্সিটির স্টুডেন্টদের আন্তরিক ভালবাসায় সে যাত্রায় আমার রুপা বেচে উঠে। ওই এগার দিনে ওরা রুপাকে ১৬ ব্যাগ রক্ত যোগাড় করে দেয়। যতদিন ওখানে ছিলাম ওদের আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না। আমার হাত ভেঙ্গে গেলেও আল্লাহর রহমতে রুপকথার কিছু হয়নি। এতোবড় দুর্ঘটনার পরেও মা-মেয়েকে নিয়ে প্রানে বেচে গেছি...তার জন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। পায়ের হাড়ে অপারেশন করার জন্য রুপা গত ৬ মাস রুপা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি । ডাক্তার অবশ্য বলেছেন খুব দ্রুত সেরে উঠে হাটতে পারবে সে।

এবারের ১লা ফাল্গুনে আমার হলুদকন্যাকে খুব মিস করব। সেদিন মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরবো আমার ছোট্ট হলুদকন্যা রুপকথাকে সঙ্গে নিয়ে। সেদিন হয়তো কেউ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবে না...তাতে কি...আমি জড়িয়ে ধরবো আমার ছোট্ট হলুদকন্যাকে। এখন আমি স্বপ্ন দেখি সেই পহেলা ফাগুনের, যে ফাগুনে আমি বেরিয়ে পরবো আমার পালসার মোটর সাইকেল নিয়ে...যার পেছনে বসে আমার হলুদকন্যা রুপা পরম মমতায় জড়িয়ে ধরবে আমায়...আর আমি জড়িয়ে ধরবো আমার ছোট্ট হলুদকন্যা রুপকথাকে। সেদিন এই দুনিয়ায় আমার চেয়ে বেশি সুখী আর কেউ থাকবে কি......আপনারাই বলুন?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন