। আমার রাজকণ্যা ।।
by Ahnuf Sunvee
গোধূলি লগন ।
পশ্চিমের সূর্যটা রক্তলাল । একটা সুন্দর দিনের অন্তীমকাল । সূর্যের আলো সৈকতের বালিয়ারিতে সোনালী আভার সৃষ্টি করেছে । সূর্যটা আস্তে আস্তে আকাশ থেকে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ।
সাগর , আকাশ আর সূর্যের অদ্ভুত সুন্দর মৈত্রিকে প্রাণভরে উপভোগ করছে রাতুল ।
অজানা এক ভাললাগায় ভরে উঠেছে তার প্রাণ । তন্ময় হয়ে প্রকৃতির অপূরূপ সৈন্দর্যকে গ্রাস করছে তার কল্পনা বিলাসী মন । বাড়ি ফেরা পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিতো চারদিক ।
এতো সুন্দর দৃশ্যটা দেখতে দেখতে নিজের কাজটার কথাই কিছুক্ষনের জন্য ভুলে গিয়েছিলো সে । হটাত্ই যেনো বাস্তবে ফিরে এলো রাতুল ।হাতের ক্যামেরাটা চোখের সামনে তুলে ধরলো সে । ঐ নয়নাভীরাম দৃশ্যের কিছু সুন্দর ছবি তার চাই ই চাই ।
ক্যামেরার ল্যান্স ঘুড়িয়ে ঠিক করে নিচ্ছে সে । কয়েকটা ছবিও তুলে ফেলল । হটাত্ই ক্যামেরার ল্যান্সে ধরা পরলো এক মানবীর আকৃতি । বেশ দূরে সাগরের পানিতে দাড়িয়ে আছে মেয়েটা । রাতুল চোখ থেকে ক্যামেরা সরিয়ে দেখতে চাইলো । কিন্তু সে অনেক দূরে থাকায় মেয়েটাকে ভালভাবে দেখতে পেলো না । তাই আবার ক্যামেরাটাকে চোখের সামনে তুলে ধরলো সে । ক্যামেরার ল্যান্সগুলো দ্রুত ঠিক করে নিলো সে ।
মেয়েটা একটা সাদা রংয়ের সেলোয়ার কামিজ পরে আছে । রাতুলের দিকে পিছন ফিরে আছে সে । গৌধূলির রক্তলাল আভা এসে পরছে মেয়েটার শরীরে । অপূর্ব দৃশ্যটা কিছুতেই মিস করতে চাইলো না রাতুল । টপাটপ কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল সে ।আরো কিছু ছবি তোলার ইচ্ছা ছিলো তার । কিন্তু তার আগেই সূর্যটা টুপ করে ডুবে গেলো ।
ক্যামেরার ফ্লাসটাও আনা হয়নি ভুলে । কি আর করা ?
রাতুল চোখের সামনে থেকে ক্যামেরা সরিয়ে মেয়েটা যেদিকে দাড়িয়ে ছিলো সেখানে তাকালো ।
কিন্তু সেখানে কাওকে দেখতে পেলো না । রাতুল একটু হতাশ হয়েছে বটে । তবে এতো দিন পর সে তার সপ্নে দেখা রাজকণ্যার সাথে একজনের মিল খুঁজে পেয়েছে । মনে মনে খুশি রাতুল । তার খুব জানতে ইচ্ছা করছে কে এই মেয়ে ! চিন্তাটা নিজের কাছেই হাস্যকর লাগলো তার । মুচকি হেসে কটেজের পথে হাটা ধরলো সে ।
(২)
রাতুল চৌধুরি । শিল্পপতি রাহাত চৌধুরির একমাত্র ছেলে । রাহাত সাহেব ছেলে ভীষন ভালবাসেন । ছোট থাকতেই রাতুলের মা মারা যায় , তারপর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করেননি রাহাত সাহেব । কষ্ট জিনিসটা কখনো বুঝতে দিতে চাননি রাতুলকে । ছেলের সব আবদার মেনে নিতে প্রস্তুত তিনি ।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো রাতুলের চাহিদা নেই বললেই চলে । খুবই অদ্ভুত একটা ছেলে সে । জাকজমক একদম পছন্দ নয় তার । নম্র , ভদ্র এবং আত্মকেন্দিক ছেলে সে । বিলাসীতার মধ্যে বড় হলেও বিলাসীতা স্পর্শ করতে পারেনি তাকে । ৮-১০ টা সাধারন ছেলের মতই আচরন তার । ভীষন লাজুক ছেলে , এবং প্রচন্ড মেধাবী । কেম্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক খেতাব পকেটে পুড়েছে সে । গত পাচঁ বছর দেশের বাইরে ছিলো রাতুল । মাস দুয়েক হলো দেশে ফিরেছে । রাহাত সাহেব তার ছেলেকে খুব ভালভাবেই চিনেন । গর্বও হয় এমন সোনার টুকরো ছেলেকে নিয়ে ।
ইদানিং রাহাত সাহেবের ব্লাড প্রেসারটা বেড়েছে । ডাক্তার তাকে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে বলেছেন । ডাক্তারের কথামতই ছেলেকে নিয়ে কক্সবাজার আসা । তবে ঐ ছুটি কাটানোর পিছনেও একটা উদ্দেশ্য আছে রাহাত সাহেবের । এবং তা হলো রাতুলের বিয়ে । তার বাউন্ডুলে , আত্মভোলা ছেলেটার গলায় একটা মিষ্টি মেয়েকে ঝুলিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা তার । এ সর্ম্পকে রাতুলকে আকারে ইঙ্গিতে অনেক প্রশ্ন করেছেন রাহাত সাহেব যে রাতুলের কোন পছন্দ আছে কিনা । জবাবে রাতুল সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো যে সে তার বাবার পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করবে ।
তার উত্তর শুনে রাহাত সাহেব একটু অবাক হয়েছেন বৈকি । আজকালকের ছেলেদের তো গার্লফ্রেন্ড ছাড়া চিন্তাই করা যায় না । তার উপর রাতুল এতগুলো বছর বিদেশে ছিলো ! রাতুল লেখালেখি করে , পাশাপাশি শখের ফটোগ্রাফারও সে । রাহাত সাহেব তার ডাইরি আর ছবিগুলো ঘেটেছিলেন । কিন্তু ঐ পর্যন্তই । এখনও তিনি এমন কিছুই পাননি যাতে বুঝতে পারবেন যে রাতুল কাওকে পছন্দ করে কিনা অথবা তার পছন্দ কেমন ।
তাই ভদ্রলোক নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । অনেকটা "যদি তোর ডাক শুনে কেও না আসে , তবে একলা চল রে ।" স্টাইলে । তবে তার ক্ষেত্রে গানটার লাইনগুলো পরিবর্তীত হয়ে দাড়াবে "যদি তোর ডাক শুনে ছেলে পাত্তা না দেয় রে , তবে একাই পাত্রী খুঁজো রে !" পাত্রী অবশ্য তৈরি । এবং রাহাত সাহেবের অতি পরিচিত । পাত্রী আর কেও নয় । রাহাত সাহেবের বাল্যকালের বন্ধু এবং ব্যাবসায়িক পার্টনার সামাদ আহমেদের মেয়ে রোদেলা । রোদেলা মেয়েটাকে খুব ভালো লাগে রাহাত সাহেবের । রাতুলের সাথে বেশ মানাবে । রোদেলা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্রী । যেমন ভদ্র তেমনি নামাজী । তাছাড়া রোদেলা মেয়েটা খুবই মিষ্টি দেখতে ।
সামাদ সাহেবকে যখন রাহাত চৌধুরি প্রস্তাব দিয়েছিলেন । সামাদ সাহেব সাথে সাথে হ্যা বলে দিয়েছিলেন। কেননা রাতুলের মতো ছেলে পাওয়া ভার ! আর রোদেলা ?
সে তো ইন্টারে পড়া অবস্থায়তেই ক্রাস খেয়েছে রাতুলের উপর । কত সপ্ন তার ! অথচ গাঁধাটা যেনো বুঝেও বোঝে না ।রাহাত সাহেব অবশ্য তাকে কিছু বুদ্ধি দিয়েছেন , যার ফলে রাতুল প্রভাবিত হবে । তবে রোদেলার আলাদা একটা প্ল্যান আছে । সে চায় রাতুলও যেনো তাকে ভালবাসে ।
(৩)
কক্সবাজারে রাহাত সাহেবের একটা ব্যাক্তিগত কটেজ আছে । এখানে এসে তারা ওখানেই উঠেছে । রাতুল কটেজে ঢুকছে । কিন্তু তার চোখ তখন ক্যামেরার ডিজিটাল স্ক্রিনে । অচেনা মেয়েটার ছবিগুলো দেখছে সে । রাতুলের খুব ইচ্ছা করছে মেয়েটা কে , ওটা জানার । এক অন্যরকম আকর্ষন অনূভব করছে সে । ক্যামেরা নিয়ে এতোটাই ব্যাস্ত ছিলো সে , যে সামনে বাশেঁর খুটিটা চোখেই পরলো না তার ।
সরাসরি গিয়ে খুঁটিটার সাথে ধাক্কা খেলো সে । মাথা ঠুকে গেলো খুঁটিটার সাথে । চোখের সামনে হাজারটা তারা জ্বলে উঠলো তার । "আউচ" শব্দ করে মাটিতে বসে গেলো সে । এবং একই সাথে ভূপতিত হয়েছে তার চশমা আর ক্যামেরা । ততক্ষনাত্ খিল খিল করে হেসে উঠলো একটা নারী কন্ঠ । মাথাটা ব্যাথায় দপদপ করছিলো রাতুলের । কিন্তু ঐ হাসির শব্দে মাথা ব্যাথা কিছুক্ষনের জন্য উধাও হয়ে গেলো তার ।
হাসির শব্দে বিস্মিত হলো রাতুল । হাতড়ে হাতড়ে চশমাটা খুঁজে চোখে লাগালো সে । তার মাত্র কয়েকফুট দূরে দাড়িয়ে আছে একটা মেয়ে । বেদম হাসছে মেয়েটা । হাসতে হাসতে মেয়েটার দেহ ঝাকি খাচ্ছে বার বার । রাতুল বেশ অবাক হলো । মেয়েটাকে তার বেশ চেনা চেনা লাগছে । তার মনে হচ্ছে কোথায় যেনো দেখেছে সে তাকে । ঠিক মনে করতে পারছে না ।
মেয়েটা হাসতে হাসতেই বললো "কানাই মাষ্টার ! দেখে চলতে পারো না ?চোখ কোথায় থাকে ? একটা না , দুইটা না ! চার চারটা চোখ তোমার ! তারপরও দেখতে পাও না ! " বিদ্যুত্ এর চমকের মতো মেয়েটাকে চিনতে পারলো রাতুল । মেয়েটা রোদেলা । রাতুল রোদেলাকে একটু ভয় পায় । ত্যাদর মেয়ে । এধরনের মেয়ে থেকে ১০০ হাত দূরে থাকতেই পছন্দ করে সে । কোনমতে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে উঠে দাড়িয়েই একটা দৌড় দিতে চাইলো রাতুল । কিন্তু মেয়েটা তার পথরোধ করে দাড়ালো ।
মেয়েটার মুখে দুষ্ট হাসির রেখা । হাসতে হাসতে বলল "ওলে ওলে কানাই মাষ্টার ভয় পেয়েছো ? কেনো ? আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক ?" রাতুল উত্তর দেয় না । মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে সে । রাগে পিত্ত জ্বলে যাচ্ছে তার , কিন্তু লজ্জ্বার কারনে কিছু বলতে পাচ্ছে না । মুখ দিয়ে চুক চুক আয়োয়াজ করলো রোদেলা । ব্যাঙ্গাত্মক কন্ঠে বলল "তোমার জন্য আঙ্কেল মেয়ে খুঁজছে ! ! তোমার জন্য ! ! আরে তোমার মতো একটা ভীতু কানাই মাষ্টারকে কে বিয়ে করবে !"
রাতুলের মেজাজ ততক্ষনে সপ্তমে চড়ে গেছে । রোদেলা বুঝতে পারছে রাতুল রেগে গেছে । তাই আবার বলল "যাও যাও । ঘুমাও গিয়ে ।" বলেই চলে গেলো সে । রাতুল অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রোদেলার গমন পথের দিকে । নিজের রুমে ফিরে গেলো সে । সারাটা দিক অনেক ধকল গেছে তার । ভীষন ক্লান্ত লাগছে তার ।
রুমে ঢুকেই ধপ্ করে শুয়ে পরলো সে । কিছুক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো সে ।রাতুল সপ্ন দেখছে . . .সে সৈকতে একাকি হাটছে । জোত্স্নার আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিতো । পুরো সৈকত খালি । শুধু সে দাড়িয়ে আছে একা । হটাত্ সাগরের হাটুপানিতে দাড়িয়ে থাকা একটা মানবীর আকৃতি তার দৃষ্টি আকর্ষন করলো । মেয়েটা তার দিকে পিছন ফিরে দাড়িয়ে আছে ।
রাতুল আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে থাকে মেয়েটার দিকে । মেয়েটার মুখ দেখতে ব্যাকুল সে । মেয়েটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে . . . . . কিন্তু সবসময় মাঝপথে যেতেই সপ্নটা ভেঙ্গে যায় ! আজকেও ভেঙ্গে গেলো । ঐ সপ্নে দেখা রাজকণ্যাকে নিয়ে প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিজের ডাইরিতে লিখে রাখে সে ।
যেমন কয়েকদিন আগেই একটা লাইন লিখেছিলো "আমার সপ্নে দেখা রাজকণ্যা হাসে ।"
এরকম অসংখ্য ইচ্ছার কথাগুলো সে ডাইরির পাতায় আবদ্ধ করে রাখে । মাঝে মাঝে ডাইরি খুলে পড়ে । শিহোরিত হয় নিজ থেকেই । আজকেও চোখে চশমা লাগিয়ে বিছানা থেকে উঠে টেবিলে গিয়ে বসলো সে । রুমের জানালাটা খোলা । সেখান দিয়ে জোত্সার আলো এসে পরছে ঘড়ে । অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। ডাইরিটা খুঁজছে রাতুল । কিন্তু অনেক খুঁজেও পাচ্ছে না সেটা। হটাত্ কি মনে হতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো রাতুল । তাদের কটেজটা থেকে সৈকত দেখতে পাওয়া যায় । অবাক হয়ে রাতুল দেখলো সৈকতে একটা মেয়ে হাটছে । মেয়েটার পরনে শুভ্র সাদা পোষাক । ঠিক যেমনটা সে তার সপ্নে দেখেছে ।
(৪)
দৌড়ে কটেজ থেকে বেড়িয়ে এলো রাতুল । আজকে তার দেখতেই হবে মেয়েটাকে । প্রাণপনে ছুটছে সে । হটাত্ মাঝপথে এসে দাড়িয়ে গেলো সে । মেয়েটা ফিরে দাড়িয়েছে । দূর থেকে অস্পষ্টভাবে রাতুল দেখতে পেলো মেয়েটা হাসছে । আস্তে আস্তে হেটে আসছে রাতুলের দিকে । রাতুলও মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটার দিকে । কাছাকাছি আসার পর রাতুল অবাক বিস্ময়ে দেখলো , মেয়েটা তার অতি পরিচিতো ।
মেয়েটা যে রোদেলা ! রোদেলার মুখে মিষ্টি একটা হাসি । শুভ্র , সাদা একটা সেলোয়ার কামিজ পরে আছে সে । রোদেলার এই রূপটা রাতুলের পরিচিত নয় । অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে সে রোদেলার দিকে । তার সপ্নে দেখা রাজকণ্যার সাথে রোদেলার অদ্ভুত মিল । বিশ্বাসই হচ্ছে না রাতুলের । তার সব কিছু উলটপালট হয়ে যাচ্ছে । তার মনে হচ্ছে রোদেলাকেই এতোদিন সে দেখে এসেছে তার সপ্নে ।
তাহলে কি তার সপ্ন সত্যি হয়েছে ? তাহলে কি সে প্রেমে পরেছে ? বিস্ময় আর মুগ্ধতা মাখা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে রোদেলার দিকে । রাতুল এভাবে চেয়ে থাকাতে লজ্জ্বা পেলো রোদেলা । লাজুক স্বরে মুচকি হেসে বললো "কি দেখো অমন করে ?" রাতুল যেনো ঘোরের মধ্যে উত্তর দিলো "আমার সপ্নে দেখা রাজকণ্যা হাসে ! !" খিল খিল করে হেসে উঠলো রোদেলা । হাতে ধরে থাকা ডাইরিটা দেখালো রাতুলকে । রাতুল বুঝলো যে রোদেলা তার ডাইরি পড়ে এসব করেছে । তার সপ্নের কথা জানতে পেরেছে ডাইরিটা পড়েই ।
কিন্তু তাতে কি ?
রাতুলের ইচ্ছা ছিলো , তার সপ্নে দেখা রাজকণ্যাকে দেখার । ঐ রাজকণ্যার মুক্তোঝড়া হাসি শোনার ।
এই তো তার সামনে হাসছে তার সপ্নে দেখা রাজকণ্যা ।
মুচকি হাসি ফুটে উঠলো রাতুলের ঠোটে । যা একটা বিরল ঘটনাই বটে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন