রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

। আমার রাজকণ্যা ।।


আমার রাজকণ্যা ।।
by Ahnuf Sunvee

গোধূলি লগন
পশ্চিমের সূর্যটা রক্তলাল একটা সুন্দর দিনের অন্তীমকাল সূর্যের আলো সৈকতের বালিয়ারিতে সোনালী আভার সৃষ্টি করেছে সূর্যটা আস্তে আস্তে আকাশ থেকে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে
সাগর , আকাশ আর সূর্যের অদ্ভুত সুন্দর মৈত্রিকে প্রাণভরে উপভোগ করছে রাতুল
অজানা এক ভাললাগায় ভরে উঠেছে তার প্রাণ তন্ময় হয়ে প্রকৃতির অপূরূপ সৈন্দর্যকে গ্রাস করছে তার কল্পনা বিলাসী মন বাড়ি ফেরা পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিতো চারদিক
এতো সুন্দর দৃশ্যটা দেখতে দেখতে নিজের কাজটার কথাই কিছুক্ষনের জন্য ভুলে গিয়েছিলো সে হটাত্ যেনো বাস্তবে ফিরে এলো রাতুল হাতের ক্যামেরাটা চোখের সামনে তুলে ধরলো সে নয়নাভীরাম দৃশ্যের কিছু সুন্দর ছবি তার চাই চাই
ক্যামেরার ল্যান্স ঘুড়িয়ে ঠিক করে নিচ্ছে সে কয়েকটা ছবিও তুলে ফেলল হটাত্ ক্যামেরার ল্যান্সে ধরা পরলো এক মানবীর আকৃতি বেশ দূরে সাগরের পানিতে দাড়িয়ে আছে মেয়েটা রাতুল চোখ থেকে ক্যামেরা সরিয়ে দেখতে চাইলো কিন্তু সে অনেক দূরে থাকায় মেয়েটাকে ভালভাবে দেখতে পেলো না তাই আবার ক্যামেরাটাকে চোখের সামনে তুলে ধরলো সে ক্যামেরার ল্যান্সগুলো দ্রুত ঠিক করে নিলো সে
মেয়েটা একটা সাদা রংয়ের সেলোয়ার কামিজ পরে আছে রাতুলের দিকে পিছন ফিরে আছে সে গৌধূলির রক্তলাল আভা এসে পরছে মেয়েটার শরীরে অপূর্ব দৃশ্যটা কিছুতেই মিস করতে চাইলো না রাতুল টপাটপ কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল সে আরো কিছু ছবি তোলার ইচ্ছা ছিলো তার কিন্তু তার আগেই সূর্যটা টুপ করে ডুবে গেলো
ক্যামেরার ফ্লাসটাও আনা হয়নি ভুলে কি আর করা ?
রাতুল চোখের সামনে থেকে ক্যামেরা সরিয়ে মেয়েটা যেদিকে দাড়িয়ে ছিলো সেখানে তাকালো
কিন্তু সেখানে কাওকে দেখতে পেলো না রাতুল একটু হতাশ হয়েছে বটে তবে এতো দিন পর সে তার সপ্নে দেখা রাজকণ্যার সাথে একজনের মিল খুঁজে পেয়েছে মনে মনে খুশি রাতুল তার খুব জানতে ইচ্ছা করছে কে এই মেয়ে ! চিন্তাটা নিজের কাছেই হাস্যকর লাগলো তার মুচকি হেসে কটেজের পথে হাটা ধরলো সে
()
রাতুল চৌধুরি শিল্পপতি রাহাত চৌধুরির একমাত্র ছেলে রাহাত সাহেব ছেলে ভীষন ভালবাসেন ছোট থাকতেই রাতুলের মা মারা যায় , তারপর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করেননি রাহাত সাহেব কষ্ট জিনিসটা কখনো বুঝতে দিতে চাননি রাতুলকে ছেলের সব আবদার মেনে নিতে প্রস্তুত তিনি
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো রাতুলের চাহিদা নেই বললেই চলে খুবই অদ্ভুত একটা ছেলে সে জাকজমক একদম পছন্দ নয় তার নম্র , ভদ্র এবং আত্মকেন্দিক ছেলে সে বিলাসীতার মধ্যে বড় হলেও বিলাসীতা স্পর্শ করতে পারেনি তাকে -১০ টা সাধারন ছেলের মতই আচরন তার ভীষন লাজুক ছেলে , এবং প্রচন্ড মেধাবী কেম্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক খেতাব পকেটে পুড়েছে সে গত পাচঁ বছর দেশের বাইরে ছিলো রাতুল মাস দুয়েক হলো দেশে ফিরেছে রাহাত সাহেব তার ছেলেকে খুব ভালভাবেই চিনেন গর্বও হয় এমন সোনার টুকরো ছেলেকে নিয়ে

ইদানিং রাহাত সাহেবের ব্লাড প্রেসারটা বেড়েছে ডাক্তার তাকে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে বলেছেন ডাক্তারের কথামতই ছেলেকে নিয়ে কক্সবাজার আসা তবে ছুটি কাটানোর পিছনেও একটা উদ্দেশ্য আছে রাহাত সাহেবের এবং তা হলো রাতুলের বিয়ে তার বাউন্ডুলে , আত্মভোলা ছেলেটার গলায় একটা মিষ্টি মেয়েকে ঝুলিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা তার সর্ম্পকে রাতুলকে আকারে ইঙ্গিতে অনেক প্রশ্ন করেছেন রাহাত সাহেব যে রাতুলের কোন পছন্দ আছে কিনা জবাবে রাতুল সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো যে সে তার বাবার পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করবে
তার উত্তর শুনে রাহাত সাহেব একটু অবাক হয়েছেন বৈকি আজকালকের ছেলেদের তো গার্লফ্রেন্ড ছাড়া চিন্তাই করা যায় না তার উপর রাতুল এতগুলো বছর বিদেশে ছিলো ! রাতুল লেখালেখি করে , পাশাপাশি শখের ফটোগ্রাফারও সে রাহাত সাহেব তার ডাইরি আর ছবিগুলো ঘেটেছিলেন কিন্তু পর্যন্তই এখনও তিনি এমন কিছুই পাননি যাতে বুঝতে পারবেন যে রাতুল কাওকে পছন্দ করে কিনা অথবা তার পছন্দ কেমন
তাই ভদ্রলোক নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকটা "যদি তোর ডাক শুনে কেও না আসে , তবে একলা চল রে " স্টাইলে তবে তার ক্ষেত্রে গানটার লাইনগুলো পরিবর্তীত হয়ে দাড়াবে "যদি তোর ডাক শুনে ছেলে পাত্তা না দেয় রে , তবে একাই পাত্রী খুঁজো রে !" পাত্রী অবশ্য তৈরি এবং রাহাত সাহেবের অতি পরিচিত পাত্রী আর কেও নয় রাহাত সাহেবের বাল্যকালের বন্ধু এবং ব্যাবসায়িক পার্টনার সামাদ আহমেদের মেয়ে রোদেলা রোদেলা মেয়েটাকে খুব ভালো লাগে রাহাত সাহেবের রাতুলের সাথে বেশ মানাবে রোদেলা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্রী যেমন ভদ্র তেমনি নামাজী তাছাড়া রোদেলা মেয়েটা খুবই মিষ্টি দেখতে
সামাদ সাহেবকে যখন রাহাত চৌধুরি প্রস্তাব দিয়েছিলেন সামাদ সাহেব সাথে সাথে হ্যা বলে দিয়েছিলেন। কেননা রাতুলের মতো ছেলে পাওয়া ভার ! আর রোদেলা ?
সে তো ইন্টারে পড়া অবস্থায়তেই ক্রাস খেয়েছে রাতুলের উপর কত সপ্ন তার ! অথচ গাঁধাটা যেনো বুঝেও বোঝে না রাহাত সাহেব অবশ্য তাকে কিছু বুদ্ধি দিয়েছেন , যার ফলে রাতুল প্রভাবিত হবে তবে রোদেলার আলাদা একটা প্ল্যান আছে সে চায় রাতুলও যেনো তাকে ভালবাসে
()
কক্সবাজারে রাহাত সাহেবের একটা ব্যাক্তিগত কটেজ আছে এখানে এসে তারা ওখানেই উঠেছে রাতুল কটেজে ঢুকছে কিন্তু তার চোখ তখন ক্যামেরার ডিজিটাল স্ক্রিনে অচেনা মেয়েটার ছবিগুলো দেখছে সে রাতুলের খুব ইচ্ছা করছে মেয়েটা কে , ওটা জানার এক অন্যরকম আকর্ষন অনূভব করছে সে ক্যামেরা নিয়ে এতোটাই ব্যাস্ত ছিলো সে , যে সামনে বাশেঁর খুটিটা চোখেই পরলো না তার
সরাসরি গিয়ে খুঁটিটার সাথে ধাক্কা খেলো সে মাথা ঠুকে গেলো খুঁটিটার সাথে চোখের সামনে হাজারটা তারা জ্বলে উঠলো তার "আউচ" শব্দ করে মাটিতে বসে গেলো সে এবং একই সাথে ভূপতিত হয়েছে তার চশমা আর ক্যামেরা ততক্ষনাত্খিল খিল করে হেসে উঠলো একটা নারী কন্ঠ মাথাটা ব্যাথায় দপদপ করছিলো রাতুলের কিন্তু হাসির শব্দে মাথা ব্যাথা কিছুক্ষনের জন্য উধাও হয়ে গেলো তার
হাসির শব্দে বিস্মিত হলো রাতুল হাতড়ে হাতড়ে চশমাটা খুঁজে চোখে লাগালো সে তার মাত্র কয়েকফুট দূরে দাড়িয়ে আছে একটা মেয়ে বেদম হাসছে মেয়েটা হাসতে হাসতে মেয়েটার দেহ ঝাকি খাচ্ছে বার বার রাতুল বেশ অবাক হলো মেয়েটাকে তার বেশ চেনা চেনা লাগছে তার মনে হচ্ছে কোথায় যেনো দেখেছে সে তাকে ঠিক মনে করতে পারছে না
মেয়েটা হাসতে হাসতেই বললো "কানাই মাষ্টার ! দেখে চলতে পারো না ?চোখ কোথায় থাকে ? একটা না , দুইটা না ! চার চারটা চোখ তোমার ! তারপরও দেখতে পাও না ! " বিদ্যুত্এর চমকের মতো মেয়েটাকে চিনতে পারলো রাতুল মেয়েটা রোদেলা রাতুল রোদেলাকে একটু ভয় পায় ত্যাদর মেয়ে এধরনের মেয়ে থেকে ১০০ হাত দূরে থাকতেই পছন্দ করে সে কোনমতে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে উঠে দাড়িয়েই একটা দৌড় দিতে চাইলো রাতুল কিন্তু মেয়েটা তার পথরোধ করে দাড়ালো
মেয়েটার মুখে দুষ্ট হাসির রেখা হাসতে হাসতে বলল "ওলে ওলে কানাই মাষ্টার ভয় পেয়েছো ? কেনো ? আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক ?" রাতুল উত্তর দেয় না মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে সে রাগে পিত্ত জ্বলে যাচ্ছে তার , কিন্তু লজ্জ্বার কারনে কিছু বলতে পাচ্ছে না মুখ দিয়ে চুক চুক আয়োয়াজ করলো রোদেলা ব্যাঙ্গাত্মক কন্ঠে বলল "তোমার জন্য আঙ্কেল মেয়ে খুঁজছে ! ! তোমার জন্য ! ! আরে তোমার মতো একটা ভীতু কানাই মাষ্টারকে কে বিয়ে করবে !"
রাতুলের মেজাজ ততক্ষনে সপ্তমে চড়ে গেছে রোদেলা বুঝতে পারছে রাতুল রেগে গেছে তাই আবার বলল "যাও যাও ঘুমাও গিয়ে " বলেই চলে গেলো সে রাতুল অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রোদেলার গমন পথের দিকে নিজের রুমে ফিরে গেলো সে সারাটা দিক অনেক ধকল গেছে তার ভীষন ক্লান্ত লাগছে তার
রুমে ঢুকেই ধপ্ করে শুয়ে পরলো সে কিছুক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো সে রাতুল সপ্ন দেখছে . . .সে সৈকতে একাকি হাটছে জোত্স্নার আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিতো পুরো সৈকত খালি শুধু সে দাড়িয়ে আছে একা হটাত্সাগরের হাটুপানিতে দাড়িয়ে থাকা একটা মানবীর আকৃতি তার দৃষ্টি আকর্ষন করলো মেয়েটা তার দিকে পিছন ফিরে দাড়িয়ে আছে
রাতুল আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে থাকে মেয়েটার দিকে মেয়েটার মুখ দেখতে ব্যাকুল সে মেয়েটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে . . . . . কিন্তু সবসময় মাঝপথে যেতেই সপ্নটা ভেঙ্গে যায় ! আজকেও ভেঙ্গে গেলো সপ্নে দেখা রাজকণ্যাকে নিয়ে প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিজের ডাইরিতে লিখে রাখে সে
যেমন কয়েকদিন আগেই একটা লাইন লিখেছিলো "আমার সপ্নে দেখা রাজকণ্যা হাসে "
এরকম অসংখ্য ইচ্ছার কথাগুলো সে ডাইরির পাতায় আবদ্ধ করে রাখে মাঝে মাঝে ডাইরি খুলে পড়ে শিহোরিত হয় নিজ থেকেই আজকেও চোখে চশমা লাগিয়ে বিছানা থেকে উঠে টেবিলে গিয়ে বসলো সে রুমের জানালাটা খোলা সেখান দিয়ে জোত্সার আলো এসে পরছে ঘড়ে অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। ডাইরিটা খুঁজছে রাতুল কিন্তু অনেক খুঁজেও পাচ্ছে না সেটা। হটাত্কি মনে হতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো রাতুল তাদের কটেজটা থেকে সৈকত দেখতে পাওয়া যায় অবাক হয়ে রাতুল দেখলো সৈকতে একটা মেয়ে হাটছে মেয়েটার পরনে শুভ্র সাদা পোষাক ঠিক যেমনটা সে তার সপ্নে দেখেছে
()
দৌড়ে কটেজ থেকে বেড়িয়ে এলো রাতুল আজকে তার দেখতেই হবে মেয়েটাকে প্রাণপনে ছুটছে সে হটাত্মাঝপথে এসে দাড়িয়ে গেলো সে মেয়েটা ফিরে দাড়িয়েছে দূর থেকে অস্পষ্টভাবে রাতুল দেখতে পেলো মেয়েটা হাসছে আস্তে আস্তে হেটে আসছে রাতুলের দিকে রাতুলও মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটার দিকে কাছাকাছি আসার পর রাতুল অবাক বিস্ময়ে দেখলো , মেয়েটা তার অতি পরিচিতো
মেয়েটা যে রোদেলা ! রোদেলার মুখে মিষ্টি একটা হাসি শুভ্র , সাদা একটা সেলোয়ার কামিজ পরে আছে সে রোদেলার এই রূপটা রাতুলের পরিচিত নয় অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে সে রোদেলার দিকে তার সপ্নে দেখা রাজকণ্যার সাথে রোদেলার অদ্ভুত মিল বিশ্বাসই হচ্ছে না রাতুলের তার সব কিছু উলটপালট হয়ে যাচ্ছে তার মনে হচ্ছে রোদেলাকেই এতোদিন সে দেখে এসেছে তার সপ্নে
তাহলে কি তার সপ্ন সত্যি হয়েছে ? তাহলে কি সে প্রেমে পরেছে ? বিস্ময় আর মুগ্ধতা মাখা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে রোদেলার দিকে রাতুল এভাবে চেয়ে থাকাতে লজ্জ্বা পেলো রোদেলা লাজুক স্বরে মুচকি হেসে বললো "কি দেখো অমন করে ?" রাতুল যেনো ঘোরের মধ্যে উত্তর দিলো "আমার সপ্নে দেখা রাজকণ্যা হাসে ! !" খিল খিল করে হেসে উঠলো রোদেলা হাতে ধরে থাকা ডাইরিটা দেখালো রাতুলকে রাতুল বুঝলো যে রোদেলা তার ডাইরি পড়ে এসব করেছে তার সপ্নের কথা জানতে পেরেছে ডাইরিটা পড়েই
কিন্তু তাতে কি ?
রাতুলের ইচ্ছা ছিলো , তার সপ্নে দেখা রাজকণ্যাকে দেখার রাজকণ্যার মুক্তোঝড়া হাসি শোনার
এই তো তার সামনে হাসছে তার সপ্নে দেখা রাজকণ্যা
মুচকি হাসি ফুটে উঠলো রাতুলের ঠোটে যা একটা বিরল ঘটনাই বটে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন