ভালবাসার রঙ নেই...(২য় পর্ব)
অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন দেখে রাত কাটল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কল করলাম ওকে।
“হ্যালো”
“আমি বলছি”
“ওহ! বল”
“আমি পরশু চলে যাচ্ছি। এটা জানানোর জন্যই ফোন করলাম”
“পরশু? ওহ! আচ্ছা ... আমি আর কি বলব! ভাল থেকো”
“কোন কিছু জানার দরকার হলে মৌ কে জিজ্ঞেস করো। ওর কাছে আমার সব খবর থাকবে”
“আচ্ছা”
“রাখি।” আমি কথা শেষ করলাম।
ওর একবারও ইচ্ছা করলো না আমার সাথে আরেকবার দেখা করতে? কি জানি! ছেলেরা মনে হয় এমনি হয়। অনুভূতিহীন!
দুই দিনের মধ্যে খুব তাড়াহুড়ো করে টিকেট বুকিং করে ফেললাম। আর থাকতে ইচ্ছে করছে না এখানে। একটা মৃত মানুষকে বাঁচিয়ে তুলে আবার মেরে ফেললে তার যেমন কষ্ট হওয়ার কথা, তেমনি কষ্ট পাচ্ছি আমি। আমার সব অনুভূতিগুলো ক্ষণিকের জন্য জীবিত করে আবার মেরে ফেলেছে। মৌ কে আমার ফ্লাইটের সময় জানিয়ে দিলাম। কেন, তা জানিনা। হয়ত মনে মনে এটাই চাচ্ছিলাম যে প্রবাল ওর কাছ থেকে খবর নিয়ে আমার সাথে এয়ারপোর্টে দেখা করতে যাক।
দুই দিন পর...
আমি এয়ারপোর্টে। কিছুক্ষণ পর আমার ফ্লাইট। দুই দিনের মধ্যে খুব তাড়াহুড়ো করে টিকেট বুকিং করেছি। আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না এখানে। একটা মৃত মানুষকে বাঁচিয়ে তুলে আবার মেরে ফেললে তার যেমন কষ্ট হওয়ার কথা, তেমনি কষ্ট পাচ্ছি আমি। আমার সব অনুভূতিগুলো ক্ষণিকের জন্য কেউ জীবিত করে আবার মেরে ফেলেছে। মৌ কে আমার ফ্লাইটের সময় জানিয়ে দিয়েছিলাম। যদি মৌ এর কাছ থেকে খবর নিয়ে ও আসে? যদি আমাকে কিছু বলতে চায়? বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছি আমি। হঠাৎ যদি ওকে ছুটে আসতে দেখি?
নাহ, ও আসেনি। সিনেমাগুলোতে এসব কী দেখায় তাহলে? সব ভুল! প্রবালের কথাই শেষমেশ সত্যি হল। অনেক আগেই ও আমাকে বলেছিল জীবন কোন হিন্দি সিনেমা না। আমার তখন কথাটা ভাল লাগেনি। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
আমি এখন ক্যালিফোর্নিয়াতে আমার বাসায়। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি একটা অপদার্থকে। কিন্তু কোথায় যেন একটা কিছু ভুল আছে। একটা শূন্যতা। নাহ, ওই গাধাকে আমি একদম মিস করছি না। আমি কী এতই সস্তা নাকি? আমাকে পাত্তা দিবেনা, আর আমি ওর পেছনে ঘুরেই যাবো?
রাতে স্বপ্নে দেখলাম প্রবাল আমার হাত ধরে আছে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু ও কাঁদছে কেন? ঘুম ভেঙ্গে গেল। অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চোখের পানি এত গরম হয় কেন? নাকি অনুভূতি যত তীব্র, অশ্রু ততো উষ্ণ হয়? ধ্যাত! কীসব আজেবাজে চিন্তা করি আমি।
কী ভেবে হঠাৎ ফোনটা হাতে নিলাম। খুব দ্রুত ডায়াল করে ফেললাম ওর নাম্বার। আমার মাথা পুরোপুরি শূন্য এই মুহূর্তে। মাথায় কিছুই কাজ করছেনা।
“হ্যালো”
“প্রবাল, আমি।”
“ওহ! ঠিকমত পৌঁছেছ তুমি?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন আছ তুমি?”
কী বলব বুঝতে পারছিনা। আমি তো ভাল নেই! কী জবাব দেই? হঠাৎ বোকার মত ফুঁপিয়ে কাঁদা শুরু করলাম।
“এই মেয়ে! তুমি কাঁদছ কেন? শোনো, কান্নাকাটি আমার ভাল লাগেনা। একটা কাজ কর...”
“কী?” আমি তখনও ফোঁপাচ্ছি। হঠাৎ করে কী যে হয়ে গেল আমার...উফ।
“তুমি কালকে পরশুর মধ্যে টিকেট করে দেশে এসে পড়”
“আমার চাকরি?”
“ছুটি নাও। আর ইন্টারনেট তো আছেই যে কোন সময় এমপ্লয়ারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য! নেট তো শুধু প্রেম করার জন্য না!”
“ফালতু কথা বলবে না”
“আর এপার্টমেন্ট ছেড়ে দাও।
“কেন?”
“কারণ, তুমি কবে ফিরবে তার কোন ঠিক নেই”
“আচ্ছা”
ফোন রেখে দিয়ে আবার কাঁদলাম। অনেক দিনের জমিয়ে রাখা সব অশ্রু কী আজকে ঝরে পড়বে?
প্রাবাল যা যা বলেছে, সব করলাম। যদিও ওর কথার মানে আমি পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। এখন শুধুই অপেক্ষার পালা। প্রবাল কেন দেশে ফিরতে বলল আমাকে?
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
আমি এয়ারপোর্টে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ও আসেনা কেন?
পনের মিনিট দেরি করে ও আসল। হাতে একগাদা ফুল।
“এত দেরি করলে?”
“ফুল কিনতে দেরি হয়েছে। প্রথমে তো ফুল ছাড়াই এসেছলাম। পরে ভাবলাম, আমার হাতে ফুল না দেখলে যদি তুমি নাটকীয় কায়দায় কান্নাকাটি শুরু কর? তাই আবার দৌড়ে গেলাম ফুল কিনতে! তুমি তো জানই, কান্নাকাটি আমার ভাল লাগেনা।”
“ওহ!” কী বলব আমি! ফুল তো আমার জন্য আনেনি, এনেছে যাতে আমার কান্না সহ্য করতে না হয়!
“আচ্ছা এবার বল বিয়ে কবে করবে? আজকে? নাকি কয়েকদিন পর?”
“বিয়ে?”
“নয়তো আমি তোমাকে এতো তাড়াহুড়ো করে আসতে বললাম কেন? আজকেই করি, কী বল?”
“আজকে বিয়ে?” আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিনা। কেমন পাগলের মত কথা বলছে ও। আজকে নাকি বিয়ে!
“দেখ, বিয়ের জন্য আমি তো আর পাগল না। কিন্তু, তোমার থাকার কোন জায়গা নেই... আর বিয়ে ছাড়া তো তোমাকে আমি বাসায় নিয়ে রাখতে পারিনা!”
আমি ভ্রু কুঁচকালাম। এমন সময়ে মানুষ এই ধরণের রসিকতা করতে পারে?
“তোমার যা ভাল মনে হয়, তাই কর।” আমার মাথা কেমন যেন ঘুরছে। সিদ্ধান্ত নেয়ার মত ক্ষমতা নেই এই মুহূর্তে।
“তাহলে আমি আম্মুকে ফোন করি আগে?”
“ঠিক আছে, কর।”
প্রবাল আমার হবু শাশুড়িকে ফোন করল।
আমার কান্না পাচ্ছে অনেক। আজকাল মনে হয় আমার একটু বেশিই কান্না পায়।
“হুম... কথা শেষ। আম্মুকে বুঝিয়ে বলতে বলতে টায়ার্ড হয়ে গেছি। তুমি কাঁদছ নাকি আবার? কী হয়েছে?”
“কিছুনা।” আমার ইচ্ছা করছিল ওর বুকে মাথা রেখে কাঁদি। ও আমাকে জরিয়ে ধরছেনা কেন?
“কেঁদো না। চোখ মুছ” বলে পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। নাহ, গাধা এখনো গাধাই আছে। ওর বুদ্ধি কখনই হবেনা। এ কেমন মানুষের পাল্লায় পড়লাম আমি!
“বল এখন কোথায় যাবে?” প্রবাল ঘড়ি দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল।
“শাড়ি কিনতে”
“শাড়ি কিনবে? টাকা এনেছ?”
“তুমি কিনে দিবেনা?” অসহায় একটা চেহারা নিয়ে ওর দিকে তাকালাম। দেখি ও মুচকি হাসছে। আমার গোমড়া মুখ দেখে অনেক মজা পেয়েছে। এই হচ্ছেন আমার হবু স্বামী।
আমরা দুজন রিকশায়। ঠিক করেছি আগে বিয়ের টুকটাক কেনাকাটা করব, তারপর ওর বাসায় বিয়ে হবে। কয়েকজন আত্মীয় আর বন্ধুবান্ধবকে ফোনে দাওয়াত দিয়েছে প্রবাল। তবে এক সপ্তাহ পরে বৌভাত হবে ধুমধাম করে।
আমার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মত লাগছে। কিছুদিন আগেও পৃথিবীর দুই প্রান্তে ছিলাম আমরা দুজন। আর আজকে একি রিকশায় পাশাপাশি বসে আছি। আমার অবশ্য অনেক মজা লাগছে ব্যাপারটা ভাবতে। হৈমন্তীর নায়কের বলতে ইচ্ছা করছে, “আমি ইহাকে পাইলাম!” আর রিকশা জিনিসটা যিনি আবিষ্কার করেছেন তাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে অনেক, এত রোমান্টিক একটা যানবাহন আবিষ্কারের জন্য।
“আচ্ছা, তুমি কি আমাকে আগের মতই ভালবাস?” ও চুপচাপ দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“কী মনে হয়?”
“কই...আমি তো দেখিনা”
“দেখবে কিভাবে? ভালবাসার কি রঙ আছে নাকি?” বলে ও হাসতে থাকল।
আবার বলা শুরু করল,
“শোন, ভালবাসা হচ্ছে বসন্তের হাল্কা ঠাণ্ডা বাতাসের মত। এর বেশি আমি বোঝাতে পারবনা।”
আজব একটা মানুষ! ভালবাসা নাকি বাতাসের মত!
এরপর আমরা অনেকক্ষণ ধরে চুপ।
“আচ্ছা, এই বুড়ো বয়সে বর সাজতে লজ্জা লাগবেনা তোমার?” এই নিরস লোকটাকে জ্বালাতে আমার অনেক ভাল লাগে।
“লজ্জা লাগবে কেন? বিয়ে তো করছি একটা বুড়িকেই!”
“খবরদার আমাকে বুড়ি বলবে না। আমি বুড়ি হতে অনেক দেরি এখনও।”
“ওহ আচ্ছা।” আবার হাসছে। কী যন্ত্রণা!
“ওটা কি ফুচকার গাড়ি নাকি?” রাস্তার সাইডে একটা ফুচকার ভ্যান দেখিয়ে বললাম।
“হুম। এই রিকশা, থামাও। আমরা এখানেই নেমে যাব।” বলে ও রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে দিল।
“এখানে নেমে যাব মানে?”
“চল তোমাকে ফুচকা খাওয়াই আগে। তুমি না ফুচকা অনেক পছন্দ কর?”
“তুমি না একটু আগে বললে হাতে বেশি সময় নেই?”
“অসুবিধা নেই। তুমি পাঁচ-দশ মিনিটে খাওয়া শেষ করতে পারবে না?”
আমরা রিকশা থেকে নামলাম। এই বিচিত্র মানুষটা আমাকে এত ভালবাসে? চুপচাপ থেকেও মানুষ এত ভালবাসে কিভাবে? ওর চোখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে আমার। কিন্তু নিরস লোকটা আমাকে সেই সুযোগও দিলনা।
এইদিকে আমি বিয়ের চিন্তায় অস্থির, আর পৃথিবীর সবচেয়ে বেরসিক মানুষটা আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ফুচকার ভ্যানের দিকে। আবার আদেশ করার ভঙ্গিতে বলছে,
“এত বড় হিল পর কেন? ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরবে, পা ভাল থাকবে।”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন