ভালবাসার রঙ নেই...(১ম পর্ব)
প্লেন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। তের বছর পর দেশে ফিরছি। হার্টবিট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সবকিছু প্ল্যান মত হলে আরও ছয় বছর আগেই ফেরা হত, প্রবালের সাথে আমার বিয়েটাও হয়ে যেত। এখন অবশ্য এসব মনে করে লাভ নেই। বিয়ে ব্যাপারটার উপর আমার একধরণের বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে। দেশে ফিরছি শুধুমাত্র জন্মভূমিকে দেখার জন্য।
তের বছর ধরে আমি আমেরিকায় থাকি বাবা-মার সাথে। প্রবালের সাথে আমার পরিচয় অনলাইনে। আমার বান্ধবীর ক্লাসমেট ছিল প্রবাল। তারপর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে ভালবাসা। অনেকে প্রশ্ন করবে, কাউকে না দেখে ভালবাসা যায় কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেও জানিনা। অবশ্য আজকাল দূরত্ব যতই হোক না কেন, প্রযুক্তির কল্যাণে কোন মানুষই না-দেখা থাকেনা। যাই হোক, দূরত্বের কারণে আমাদের কোন সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়েছে আমার বাবা-মা কে নিয়ে। ওরা যেন একরকম জেদ ধরে বসেছিল যে আমাকে বিয়ে না দিলেও এমন “অযৌক্তিক” প্রেম ওরা মেনে নিবে না। নিরাশ হয়ে প্রবাল আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তার আগে আমাকে অনেক বুঝিয়েছে যাতে আমি মা-বাবার পছন্দের কাউকে বিয়ে করে ফেলি... জীবন তো কারও জন্য থেমে থাকেনা... ইত্যাদি। অনেক কান্নাকাটির পর ঠিক করেছিলাম প্রবাসী কোন পাগলকেই বিয়ে করে ফেলব। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও কাউকে পছন্দ হলনা। এভাবেই ছয় বছর কেটে গেছে। বাবা-মার সাথে দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে আমার। চাকরির অজুহাতে আমি ওদের থেকে অনেক দূরে একটা এপার্টমেন্টে উঠেছি। এখন তো আমি স্বাধীন, তাহলে প্রবালের সাথে যোগাযোগ করছিনা কেন? কারণ ও নিজেই যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। ওকে আর জ্বালাতে চাইনি। হয়তো ও বিয়ে করেছে, আমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছে! কী বিচিত্র এই জীবন। যখন ভালবাসা ছিল, তখন স্বাধীনতা ছিলনা। আর যখন স্বাধীনতা পেলাম, তখন ভালবাসাই নেই।
বিমান ঢাকায় পৌঁছুল। এয়ারপোর্ট থেকে আমি সরাসরি এসে উঠলাম একটা হোটেলে। আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করার কোন ইচ্ছে নেই। চিরাচরিত বাঙালি কিনা, দেখা হওয়া মাত্রই আমার বিয়ে হলনা কেন এসব নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করবে। কী দরকার!
ঢাকা শহরের চেহারা অনেক বদলে গেছে। শেরাটনের নাম হয়েছে “রূপসী বাংলা”! ভালই হয়েছে। শেরাটন নামটা কেমন যেন ছিল... বাংলা ভাষার সাথে খাপ খেত না।
পরদিন ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হল। নাশতা করে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসলাম। একটু কেনাকাটা করতে হবে। অনেকগুলো শাড়ি কিনব ঠিক করেছি। গত তের বছরে একটা শাড়িও কিনিনি। এটা কোন জীবন হল নাকি? দেশের বাইরে থাকা মানেই চিড়িয়াখানায় থাকা। তাইতো ফিরে আসতে চেয়েছিলাম... ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
একটা ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে আছি পাঁচ মিনিট ধরে। রিকশা হলেও চলবে। হঠাৎ মনে হল পাশে দাঁড়ানো লোকটা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমার মনে অনেক ধরণের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বেশিরভাগই সিনেমাটিক কল্পনা। যেমন, এই লোকটা যদি প্রবাল হয়? ওর পাশে যদি ওর বউ থাকে? প্রবাল কি তাহলে আমাকে না দেখার ভান করবে? ধ্যাত! এসব হচ্ছে অতিরিক্ত সিনেমা দেখার কুফল, সবকিছুকেই সিনেমার সাথে তুলনা করতে ইচ্ছে করে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সাহস করে ঘুরে দাঁড়ালাম। নাহ! এটা প্রবাল না। যাক... একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তাহলে এই লোক এভাবে তাকাচ্ছে কেন? ঘরে কি মা-বোন নেই নাকি? অসভ্য কোথাকার!
একটা রিকশা পেয়ে গেলাম একটু পরে। মার্কেটে গিয়ে তিনটা শাড়ি কিনলাম। তার মধ্যে একটা নীল শাড়ি। অনেক বছর আগে আমাকে কেউ একজন নীল শাড়িতে দেখতে চেয়েছিল। নাহ! এসব নিয়ে যতই কম ভাবতে চাই, তত বেশি আমাকে জেঁকে ধরে এসব চিন্তা।
আচ্ছা, মৌ কে একবার ফোন করলে কেমন হয়? ওর কাছে হয়তো প্রবালের খোঁজখবর থাকতে পারে! শুধু জিজ্ঞেস করব ও কেমন আছে, কী করে এখন। ওর মুখোমুখি দাঁড়ানোর মত মনের জোর নেই আমার।
প্রবাল কোথায় আছে, কী করছে এখন- জানার জন্য মৌ কে ফোন করলাম। মৌ তেমন কোন খবর দিতে পারল না। শুধু প্রবাল যেখানে কাজ করে তার ঠিকানা দিল। কী মনে করে আমি পরদিন সকালে ওই অফিসের সামনে চলে গেলাম। আমি তো ওর সাথে দেখা করব না, তাহলে এখানে কী করছি? নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই ভেবে যে ওকে দূর থেকে দেখেই চলে যাবো, কথা বলব না।
হঠাৎ দেখি উল্টোদিক থেকে ফরমাল পোশাক পরা এক ভদ্রলোক হেঁটে আসছে। তার চেহারা দেখে আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। এটাই তো প্রবাল! ও কি আমার দিকে আসছে নাকি? চিনেছে আমাকে? অফিসিয়াল পোষাকে ওকে দেখতে ভালই লাগছে। আগেও লাগত। ভাবতে ভাবতে ও আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছ।
“আপনি কি ঈশিতা?”
“হ্যাঁ। চিনতে কষ্ট হচ্ছে আমাকে?”
“নাহ!”
“তাহলে আপনি করে বলছ কেন?”
“আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এটা তুমি।“
আমি একটু মুচকি হাসার চেষ্টা করলাম। হাসি পেল না। ভাবছি এরপর কী বলব। এত প্রশ্ন, এত কথা জমে আছে..
“তুমি কবে এসেছ?”
“এইত, পরশু।”
তখনি ওর ফোন বেজে উঠল।
“ওহ! আমার কলিগ কল করছে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, খেয়ালই করিনি”
“আচ্ছা তুমি যাও”
ও পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে কী যেন লিখল, তারপর আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
“এটা আমার ফোন নাম্বার। ফোন করো। কোন কথাই তো হলনা। সরি”
“নো প্রবলেম। তুমি যাও।“ একটু মুচকি হেসে ওকে আশ্বস্ত করলাম। ও খুব দ্রুত হেঁটে চলে গেল। মনে মনে আশা করছিলাম যাওয়ার সময় ও একবার পেছনে ফিরে তাকাবে। নাহ, এসব শুধু সিনেমাতেই হয়।
ওর দেয়া চিরকুটটাকে শক্ত মুঠো করে ধরে রেখেছি। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিস এটা।
হোটেলে আমার রুমে বসে বারবার ঘড়ি দেখছি আমি। কোন সময়ে ফোন করলে ওকে ফ্রি পাবো, কখন কল পেয়ে ও বিরক্ত হবেনা, এসব ভাবতে ভাবতে রাত নয়টা বেজে গেছে। ডায়াল করেই ফেললাম একসময়। রিং হচ্ছে। ফোন ধরার কোন খবর নেই। পাঁচ ছয়বার কল করে বিরক্ত লাগছে। ভুল নাম্বার দিল নাকি? নাকি বউয়ের ভয়ে ফোন ধরছে না?
রাত এগারোটার দিকে একটা ফোন আসলো।
“হ্যালো”
“হ্যালো, এই নাম্বার থেকে আমি অনেকগুলো মিসড কল পেয়েছি। তাই কলব্যাক করলাম। কে বলছিলেন?”
“আমি ঈশিতা”
“তুমি কল করেছিলে? ওহ সরি! আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। মাত্র উঠলাম”
“তোমার এখনো সন্ধ্যায় ঘুমানোর অভ্যাস আছে?”
“তোমার মনে আছে এখনও?”
“মনে না থাকার কী আছে?”
হঠাৎ দুজন চুপ হয়ে গেলাম।
“ঈশিতা তুমি বিয়ে করনি?” হঠাৎ রাগি রাগি গলায় বলে উঠল ও।
“তোমাকে কে বলল বিয়ে করিনি?”
“প্রশ্নের উত্তর দাও”
“না, করিনি।” বিরক্তির সুরে জবাব দিলাম। বলতে চাচ্ছিলাম, এতদিনে এসব জানতে চাওয়ার তুমি কে?
“কেন?”
“কেন মানে কী? ইচ্ছা হয়নি, তাই করিনি। আর তাছাড়া সবাই কি তোমার মত নাকি?” শেষ লাইনটা বলার পর মনে হল ভুল করেছি। এই ধরণের কথা আমি কোন দাবি নিয়ে বলছি? আমার জন্য ওর জীবন কি থেমে থাকবে নাকি? ছিঃ! কি বোকা আমি!
“আমার মত মানে? আমি কী করেছি?”
“কিছুনা। তোমার কথা বল। তোমার বউয়ের গল্প বল”
“আমার বউ নেই”
“মানে? তুমিও বিয়ে করনি নাকি?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। অবশ্যই খুশি হইনি।
“না”
“কেন??”
“বিয়ে যে করতে চাইনি, তা না। একটা মেয়ের সাথে বিয়ের কথাবার্তা প্রায় ফাইনাল করে ফেলেছিলাম। বিয়ের কয়েকদিন আগে জানালো ও অন্য কাউকে ভালবাসে”
“ওহ”
“ তোমাদের মেয়ে মানুষদের ভেতর এত প্যাঁচ কেন? বিয়ে করবে না, তাহলে রাজি হওয়ার কী দরকার ছিল?”
“ও তোমাকে বিয়ে করেনি দেখে রাগ হচ্ছ? বেশি পছন্দ হয়েছিল ওকে?”
“উফ...তা বলছিনা! তোমরা মেয়েরা এত বেশি বোঝ কেন?” বুঝলাম পুরোপুরি বিরক্ত করে ছেড়েছি বেচারাকে।
“সরি”
“দেশে এসেছ কার সাথে? একা?”
“হুম”
“ওহ। ফিরে যাবে কবে?”
এই পর্যায়ে এসে আমার অনেক রাগ লাগল। আমাকে আর দেখাও করতে বলল না ও? কবে ফিরে যাব জানতে চাচ্ছে?
“এইত, দুই তিন দিনের মধ্যে।” যদিও এত জলদি ফেরার প্ল্যান ছিলনা আমার, তারপরও বললাম।
“ওহ। এত তারাতারি?”
“হুম” আমার আর কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা। যার কাছে আমার কোনও গুরুত্ব নেই, তার সাথে কিসের কথা?
“তুমি মনে হয় এখন ঘুমাবে”
“হ্যাঁ ঘুমাব। পরে কথা হবে তাহলে। রাখি।” বলেই ফোন রেখে দিলাম।
অনেক কষ্টে ঘুমালাম রাতে। মনে হচ্ছে কেউ আমার পুরনো ক্ষত খুঁচিয়ে রক্ত বের করছে। কান্না পাচ্ছে, আবার চোখ থেকে পানিও বের হচ্ছে না। ইচ্ছা করছে একটা কাঁচের গ্লাস গাধাটার মাথায় ছুঁড়ে মারি!
osomvob valO LIKHA
উত্তরমুছুন