শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ভালবাসার রঙ নেই...(১ম পর্ব)


ভালবাসার রঙ নেই...(১ম পর্ব)

প্লেন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি তের বছর পর দেশে ফিরছিহার্টবিট ক্রমাগত বেড়েই চলেছেসবকিছু প্ল্যান মত হলে আরও ছয় বছর আগেই ফেরা হত, প্রবালের সাথে আমার বিয়েটাও হয়ে যেতএখন অবশ্য এসব মনে করে লাভ নেইবিয়ে ব্যাপারটার উপর আমার একধরণের বিতৃষ্ণা জন্মে গেছেদেশে ফিরছি শুধুমাত্র জন্মভূমিকে দেখার জন্য
তের বছর ধরে আমি আমেরিকায় থাকি বাবা-মার সাথেপ্রবালের সাথে আমার পরিচয় অনলাইনেআমার বান্ধবীর ক্লাসমেট ছিল প্রবালতারপর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে ভালবাসাঅনেকে প্রশ্ন করবে, কাউকে না দেখে ভালবাসা যায় কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেও জানিনাঅবশ্য আজকাল দূরত্ব যতই হোক না কেন, প্রযুক্তির কল্যাণে কোন মানুষই না-দেখা থাকেনাযাই হোক, দূরত্বের কারণে আমাদের কোন সমস্যা হয়নিসমস্যা হয়েছে আমার বাবা-মা কে নিয়েওরা যেন একরকম জেদ ধরে বসেছিল যে আমাকে বিয়ে না দিলেও এমন অযৌক্তিকপ্রেম ওরা মেনে নিবে নানিরাশ হয়ে প্রবাল আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়তার আগে আমাকে অনেক বুঝিয়েছে যাতে আমি মা-বাবার পছন্দের কাউকে বিয়ে করে ফেলি... জীবন তো কারও জন্য থেমে থাকেনা... ইত্যাদিঅনেক কান্নাকাটির পর ঠিক করেছিলাম প্রবাসী কোন পাগলকেই বিয়ে করে ফেলবকিন্তু অনেক চেষ্টার পরও কাউকে পছন্দ হলনাএভাবেই ছয় বছর কেটে গেছেবাবা-মার সাথে দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে আমার চাকরির অজুহাতে আমি ওদের থেকে অনেক দূরে একটা এপার্টমেন্টে উঠেছিএখন তো আমি স্বাধীন, তাহলে প্রবালের সাথে যোগাযোগ করছিনা কেন? কারণ ও নিজেই যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেওকে আর জ্বালাতে চাইনিহয়তো ও বিয়ে করেছে, আমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছে! কী বিচিত্র এই জীবনযখন ভালবাসা ছিল, তখন স্বাধীনতা ছিলনাআর যখন স্বাধীনতা পেলাম, তখন ভালবাসাই নেই
বিমান ঢাকায় পৌঁছুলএয়ারপোর্ট থেকে আমি সরাসরি এসে উঠলাম একটা হোটেলে আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করার কোন ইচ্ছে নেইচিরাচরিত বাঙালি কিনা, দেখা হওয়া মাত্রই আমার বিয়ে হলনা কেন এসব নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করবেকী দরকার!
ঢাকা শহরের চেহারা অনেক বদলে গেছেশেরাটনের নাম হয়েছে রূপসী বাংলা”! ভালই হয়েছেশেরাটন নামটা কেমন যেন ছিল... বাংলা ভাষার সাথে খাপ খেত না
পরদিন ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হলনাশতা করে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসলামএকটু কেনাকাটা করতে হবেঅনেকগুলো শাড়ি কিনব ঠিক করেছিগত তের বছরে একটা শাড়িও কিনিনিএটা কোন জীবন হল নাকি? দেশের বাইরে থাকা মানেই চিড়িয়াখানায় থাকা তাইতো ফিরে আসতে চেয়েছিলাম... ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো
একটা ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে আছি পাঁচ মিনিট ধরেরিকশা হলেও চলবেহঠাৎ মনে হল পাশে দাঁড়ানো লোকটা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেআমার মনে অনেক ধরণের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছেবেশিরভাগই সিনেমাটিক কল্পনাযেমন, এই লোকটা যদি প্রবাল হয়? ওর পাশে যদি ওর বউ থাকে? প্রবাল কি তাহলে আমাকে না দেখার ভান করবে? ধ্যাত! এসব হচ্ছে অতিরিক্ত সিনেমা দেখার কুফল, সবকিছুকেই সিনেমার সাথে তুলনা করতে ইচ্ছে করেভাবতে ভাবতে হঠাৎ সাহস করে ঘুরে দাঁড়ালামনাহ! এটা প্রবাল নাযাক... একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললামতাহলে এই লোক এভাবে তাকাচ্ছে কেন? ঘরে কি মা-বোন নেই নাকি? অসভ্য কোথাকার!

একটা রিকশা পেয়ে গেলাম একটু পরেমার্কেটে গিয়ে তিনটা শাড়ি কিনলামতার মধ্যে একটা নীল শাড়িঅনেক বছর আগে আমাকে কেউ একজন নীল শাড়িতে দেখতে চেয়েছিল নাহ! এসব নিয়ে যতই কম ভাবতে চাই, তত বেশি আমাকে জেঁকে ধরে এসব চিন্তা
আচ্ছা, মৌ কে একবার ফোন করলে কেমন হয়? ওর কাছে হয়তো প্রবালের খোঁজখবর থাকতে পারে! শুধু জিজ্ঞেস করব ও কেমন আছে, কী করে এখনওর মুখোমুখি দাঁড়ানোর মত মনের জোর নেই আমার

প্রবাল কোথায় আছে, কী করছে এখন- জানার জন্য মৌ কে ফোন করলামমৌ তেমন কোন খবর দিতে পারল নাশুধু প্রবাল যেখানে কাজ করে তার ঠিকানা দিলকী মনে করে আমি পরদিন সকালে ওই অফিসের সামনে চলে গেলামআমি তো ওর সাথে দেখা করব না, তাহলে এখানে কী করছি? নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই ভেবে যে ওকে দূর থেকে দেখেই চলে যাবো, কথা বলব না
হঠাৎ দেখি উল্টোদিক থেকে ফরমাল পোশাক পরা এক ভদ্রলোক হেঁটে আসছেতার চেহারা দেখে আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছিএটাই তো প্রবাল! ও কি আমার দিকে আসছে নাকি? চিনেছে আমাকে? অফিসিয়াল পোষাকে ওকে দেখতে ভালই লাগছেআগেও লাগতভাবতে ভাবতে ও আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছ
আপনি কি ঈশিতা?”
হ্যাঁচিনতে কষ্ট হচ্ছে আমাকে?”
নাহ!
তাহলে আপনি করে বলছ কেন?”
আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এটা তুমি
আমি একটু মুচকি হাসার চেষ্টা করলামহাসি পেল নাভাবছি এরপর কী বলবএত প্রশ্ন, এত কথা জমে আছে..
তুমি কবে এসেছ?”
এইত, পরশু
তখনি ওর ফোন বেজে উঠল
ওহ! আমার কলিগ কল করছেআমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, খেয়ালই করিনি
আচ্ছা তুমি যাও
ও পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে কী যেন লিখল, তারপর আমার হাতে ধরিয়ে দিল
এটা আমার ফোন নাম্বারফোন করোকোন কথাই তো হলনাসরি
নো প্রবলেমতুমি যাওএকটু মুচকি হেসে ওকে আশ্বস্ত করলামও খুব দ্রুত হেঁটে চলে গেলমনে মনে আশা করছিলাম যাওয়ার সময় ও একবার পেছনে ফিরে তাকাবে নাহ, এসব শুধু সিনেমাতেই হয়
ওর দেয়া চিরকুটটাকে শক্ত মুঠো করে ধরে রেখেছিএই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিস এটা

হোটেলে আমার রুমে বসে বারবার ঘড়ি দেখছি আমিকোন সময়ে ফোন করলে ওকে ফ্রি পাবো, কখন কল পেয়ে ও বিরক্ত হবেনা, এসব ভাবতে ভাবতে রাত নয়টা বেজে গেছে ডায়াল করেই ফেললাম একসময়রিং হচ্ছেফোন ধরার কোন খবর নেইপাঁচ ছয়বার কল করে বিরক্ত লাগছেভুল নাম্বার দিল নাকি? নাকি বউয়ের ভয়ে ফোন ধরছে না?
রাত এগারোটার দিকে একটা ফোন আসলো
হ্যালো
হ্যালো, এই নাম্বার থেকে আমি অনেকগুলো মিসড কল পেয়েছিতাই কলব্যাক করলামকে বলছিলেন?”
আমি ঈশিতা
তুমি কল করেছিলে? ওহ সরি! আমি ঘুমিয়ে ছিলামমাত্র উঠলাম
তোমার এখনো সন্ধ্যায় ঘুমানোর অভ্যাস আছে?”
তোমার মনে আছে এখনও?”
মনে না থাকার কী আছে?”
হঠাৎ দুজন চুপ হয়ে গেলাম
ঈশিতা তুমি বিয়ে করনি?” হঠাৎ রাগি রাগি গলায় বলে উঠল ও
তোমাকে কে বলল বিয়ে করিনি?”
প্রশ্নের উত্তর দাও
না, করিনিবিরক্তির সুরে জবাব দিলামবলতে চাচ্ছিলাম, এতদিনে এসব জানতে চাওয়ার তুমি কে?
কেন?”
কেন মানে কী? ইচ্ছা হয়নি, তাই করিনিআর তাছাড়া সবাই কি তোমার মত নাকি?” শেষ লাইনটা বলার পর মনে হল ভুল করেছিএই ধরণের কথা আমি কোন দাবি নিয়ে বলছি? আমার জন্য ওর জীবন কি থেমে থাকবে নাকি? ছিঃ! কি বোকা আমি!
আমার মত মানে? আমি কী করেছি?”
কিছুনাতোমার কথা বলতোমার বউয়ের গল্প বল
আমার বউ নেই
মানে? তুমিও বিয়ে করনি নাকি?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলামঅবশ্যই খুশি হইনি
না
কেন??”
বিয়ে যে করতে চাইনি, তা নাএকটা মেয়ের সাথে বিয়ের কথাবার্তা প্রায় ফাইনাল করে ফেলেছিলামবিয়ের কয়েকদিন আগে জানালো ও অন্য কাউকে ভালবাসে
ওহ
তোমাদের মেয়ে মানুষদের ভেতর এত প্যাঁচ কেন? বিয়ে করবে না, তাহলে রাজি হওয়ার কী দরকার ছিল?”
ও তোমাকে বিয়ে করেনি দেখে রাগ হচ্ছ? বেশি পছন্দ হয়েছিল ওকে?”
উফ...তা বলছিনা! তোমরা মেয়েরা এত বেশি বোঝ কেন?” বুঝলাম পুরোপুরি বিরক্ত করে ছেড়েছি বেচারাকে
সরি
দেশে এসেছ কার সাথে? একা?”
হুম
ওহফিরে যাবে কবে?”
এই পর্যায়ে এসে আমার অনেক রাগ লাগলআমাকে আর দেখাও করতে বলল না ও? কবে ফিরে যাব জানতে চাচ্ছে?
এইত, দুই তিন দিনের মধ্যেযদিও এত জলদি ফেরার প্ল্যান ছিলনা আমার, তারপরও বললাম
ওহএত তারাতারি?”
হুমআমার আর কথা বলতে ইচ্ছা করছেনাযার কাছে আমার কোনও গুরুত্ব নেই, তার সাথে কিসের কথা?
তুমি মনে হয় এখন ঘুমাবে
হ্যাঁ ঘুমাবপরে কথা হবে তাহলেরাখিবলেই ফোন রেখে দিলাম
অনেক কষ্টে ঘুমালাম রাতেমনে হচ্ছে কেউ আমার পুরনো ক্ষত খুঁচিয়ে রক্ত বের করছেকান্না পাচ্ছে, আবার চোখ থেকে পানিও বের হচ্ছে নাইচ্ছা করছে একটা কাঁচের গ্লাস গাধাটার মাথায় ছুঁড়ে মারি!

1 টি মন্তব্য: