গল্পটি আর দশজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সমবয়সী একটি ছেলে ও একটি মেয়ের প্রেমের গল্পের মতই। যেখানে প্রত্যয় এবং নিয়ন্তা দুজনই সামাজিক রীতিনীতির বেড়াজালে আবদ্ধ। তবে এ গল্পের মাঝে লুকিয়ে আছে এক বিশাল ত্যাগ, যা সাধারনত বিরল।
নিয়ন্তা এবং প্রত্যয়ের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা প্রায় দু বছরের। নিয়ন্তার এক ফ্রেন্ড পুলক এর দ্বারা প্রত্যয়ের পরিচয় হয়। তারপর একই সাথে বিভিন্ন কোচিং, প্রোগ্রাম ইত্যাদির দ্বারা তারা আস্তে আস্তে একে অপরের কাছে আসতে থাকে। তাদের মাঝে যে একে অপরের প্রতি টান সৃষ্টি হয় তা তারা বুঝতে পারে, কিন্তু কেউই তাদের এ আবেগকে গভীর হওয়া থেকে বিরত রাখে নি।
একবার প্রত্যয় তার এবং নিয়ন্তার পরিচিত সব বন্ধুবান্ধবকে এক রেস্টুরেন্টে নিয়ন্তার জন্মদিনে দাওয়াত দেয়। বিষয়টি নিয়ন্তাকে সে জানায় নি। সেদিন কোচিং ক্লাস থেকে বের হয়ে সে নিয়ন্তাকে বলে “চল তকে এক জায়গা দেখিয়ে নিয়ে আসি”
এই বলে সে নিয়ন্তাকে ঐ রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। ঐ খানে গিয়ে নিয়ন্তা দেখে পুরো রেস্টুরেন্ট অন্ধকার। নিয়ন্তা ভিতরে পা ফেলা মাত্রই পুরো রেস্টুরেন্ট আলোকিত হয়ে উঠে। আর নিয়ন্তার সব ফ্রেন্ড তাকে HAPPY BIRTHDAY জানায়। এমন SURPRIZE দেখে অনেক খুশি হয়। সেই দিনই প্রত্যয় নিয়ন্তাকে তার মনের ভালোবাসার খবর জানায়। নিয়ন্তা তখন কিছুটা সময় চায়। তবে সেই রাতেই নিয়ন্তা তার সম্মতির কথা প্রত্যয়কে জানিয়ে দেয়।
নিয়ন্তা আর প্রত্যয় একই সাথে এইচ এস সি দেয়। দুজনই ভালো রেজাল্ট করে। নিয়ন্তার ডাক্তারি পড়ার অনেক শখ ছিল। কিন্তু সে কোন পাবলিক মেডিক্যাল কলেজ গুলোতে চান্স পায়নি। নিয়ন্তার বাবা টাকা পয়সার দিক থেকে ভালই সচ্ছল ছিল। তাই তিনি তার মেয়েকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকস বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেয়। কিন্তু প্রত্যয়ের পাবলিকে পড়ার অনেক শখ।
আর দশটা প্রেমের সম্পর্কের মতই চিরাচরিত নিয়মে নিয়ন্তার পরিবার প্রত্যয়কে গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। স্বাভাবিকভাবেই নিয়ন্তাকে তার পরিবার বুঝানোর চেষ্টা করে যে প্রত্যয়ের খুব একটা ব্রাইট ফিউচার নেই, তার সাথে সম্পর্ক রাখাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু না।
পরিবারের চাপে পড়ে একদিন নিয়ন্তা প্রত্যয়কে বলে, "আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা কতটা গভীর তা কি তোমাকে আজও বোঝানো লাগবে? তুমি একটা কিছু অন্তত করো। তাছাড়া আমাদের সম্পর্ক কেউ মেনে নিবে না।"
প্রত্যয় কোন উত্তর খুঁজে পায় না। সে চুপ করে থাকে। নিয়ন্তা রাগ হয়ে চলে যায়। তারপরেও স্বপ্নবাজ সেই ছেলেটা তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, কিছুটা অন্জন'দা এর গানের মতো,
"সাদা-কালো এই জন্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে,
তোমার-আমার লাল-নীল সংসার।"
একসময় প্রত্যয় হায়ার-স্টাডিসের জন্য বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যাওয়ার আগ-মুহূর্তে সে মেয়েটাকে বলে, "আমি হয়তো কথায় খুব একটা পারদর্শী না, কিন্তু আমি জানি যে আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তারপরেও তুমি যদি চাও, তোমার-আমার বিয়ের কথা আমি তোমার পরিবারকে একবার বলে দেখতে পারি। তুমি কি আমার সাথে সারাজীবন কাটাতে রাজি আছ?"
নিয়ন্তা প্রত্যয়ের দৃঢ়-সংকল্প দেখে রাজি হয়। প্রত্যয় নিয়ন্তার পরিবারকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করে ফেলে। তারপর তাদের এনগেজমেন্ট হয়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশে ফিরলে তারপর তাদের বিয়ে হবে। এরপর প্রত্যয় চলে যায় দেশের বাইরে।
নিয়ন্তা একটা অফিসে জব করা শুরু করে দেয়। এদিকে প্রত্যয় তার রিসার্চ-ওয়ার্ক নিয়ে দেশের বাইরে ব্যস্ত। তারপরেও তারা শত ব্যস্ততার মাঝেও ফোন আর ই-মেইলের মাধ্যমে তাদের ভালোবাসার অনুভূতি যতটা সম্ভব আদান-প্রদান করে।
একদিন নিয়ন্তা অফিসে যাওয়ার পথে রোড এক্সিডেন্ট করে। সেন্স ফিরে সে দেখতে পায় যে সে হাসপাতালে ভর্তি এবং বুঝতে পারে যে সে মারাত্মকভাবে আহত। তার বাবা-মাকে বিছানার পাশে দেখতে পায় সে। তার মা কান্না করতেছে তা বুঝতে পেরে যখন নিয়ন্তা কথা বলতে যায় তখন সে বুঝতে পারে যে তার বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে নিয়ন্তা তার ব্রেনে আঘাত পাওয়ায় আজীবনের মতো বোবা হয়ে গেছে।
একসময় নিয়ন্তা খানিকটা সুস্থ হয়ে বাসায় চলে আসে। এদিকে প্রত্যয় তাকে বার বার ফোন করতে থাকে কিন্তু সে বোবা বলে তার করার কিছুই থাকে না। নিয়ন্তা একদিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সে তার কথোপোকথন-হীন এই জীবনের সাথে প্রত্যয়কে আর জড়াতে চায় না।
তার ফলশ্রুতিতে সে একদিন একটা মিথ্যা চিঠিতে লেখে যে সে আর প্রত্যয়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না। তারপর নিয়ন্তা চিঠির সাথে তার এনজেজমেন্ট রিং প্রত্যয়ের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়। প্রত্যয় নিয়ন্তাকে হাজার-হাজার ই-মেইল করে কিন্তু তার কোন রিপ্লাই সে পায় না। প্রত্যয় শত-শত বার ফোন করে কিন্তু মেয়েটার ফোন রিসিভ না করে নীরবে কান্না করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
একদিন নিয়ন্তার পরিবার বাসা বদল করে অন্য কোন এলাকায় নতুন কোন একটা পরিবেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে করে মেয়েটা কিছুটা হলেও এই দুঃস্মৃতী ভূলে যায় এবং সুখে থাকে।
নতুন পরিবেশে নিয়ন্তা "সাইন-ল্যাংগুয়েজ" শেখে এবং নতুন জীবন শুরু করে। বছর দুয়েক পর একদিন নিয়ন্তার এক বান্ধবী এখানে চলে আসে এবং নিয়ন্তাকে বলে যে প্রত্যয় দেশে ব্যাক করেছে। মেয়েটা তার বান্ধবীকে রিকুয়েস্ট করে যাতে ছেলেটা কোনভাবেই যেন তার এই অবস্থার কথা জানতে না পারে। তারপর কয়েকদিন পর মেয়েটার বান্ধবী চলে যায়।
আরো এক বছর পর আবার একদিন নিয়ন্তারর বান্ধবী তার কাছে একটা ইনভাইটেশন কার্ড নিয়ে চলে আসে। নিয়ন্তা কার্ড খুলে দেখতে পায় যে এটা প্রত্যয়ের বিয়ের ইনভাইটেশন কার্ড। নিয়ন্তা অবাক হয়ে যায় যখন পাত্রীর জায়গায় তার নিজের নাম দেখতে পায়। নিয়ন্তা যখন তার বান্ধবীর কাছে এ সম্পর্কে কিছু জানতে চাইবে তখন সে দেখতে পায় যে প্রত্যয় তার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রত্যয় তখন "সাইন ল্যাংগুয়েজ" ব্যবহার করে নিয়ন্তাকে বলে, "I've spent a year's time to learn sign language. Just to let you know that I've not forgotten our promise. Let me have the chance to be your voice. I Love You."
এই বলে প্রত্যয় আবার সেই এনগেজমেন্ট রিং নিয়ন্তাকে পড়িয়ে দেয়। কয়েক বছর পর মেয়েটা আবার হেসে উঠে। এ যেন এক নীরব ভালোবাসার নীরব হাসি।
আজ তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। সে জন্য ডিনারে আজ তারা সেই রেস্টুরেন্টে এসেছে, যেখানে নিয়ন্তা তার সত্যিকারের ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়েছিলো...............
সবাই নিয়ন্তা আর প্রত্যয়ের জন্য দোয়া করবেন...........................
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন