সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

শুন্যতার খসড়াপত্র


শুন্যতার খসড়াপত্র

    নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে- চলে আসে নতুন সময়-

                     পুরনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়,

                     নতুনেরা আসিতেছে বলে!-

                     আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্থলে

                     কোনো এক মানুষীর তরে

                     যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে!

                                                                                                                                      - জীবনানন্দ দাশ

                                      …………………………………


দীপা তার রাজপুত্রের সন্ধান পেয়েছে

দীপা তার মায়ের পছন্দমতো একজন সত্যিকারের রাজপুত্রের সন্ধান করছিলোকথাটি আমাকে বেশ কয়েকবার বলার পরও আমি ভেবেছিলাম সে ঠাট্টা করছে; অভিমানের শোধ নিচ্ছেএকদিন ক্যান্টিনে বসে খাবার সময় অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে বলেছিলো, সবার আগে সে আমাকেই তার রাজপুত্রকে দেখাবেতার চোখের ভাষা সেদিন আমি বুঝতে পারিনি

এরপর হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা বাসায় ফোন করে জানালো-সন্ধ্যায় সে আসছেসাথে তার রাজপুত্রও থাকছে

আমি তখনও বুঝতে  পারিনি কী হতে চলেছেখাওয়ার সময় হঠাৎ অনুভব করলাম, ছোটো বাচ্চাদের মতো অভিমান হচ্ছেখেলার পুতুল ভেঙে যাওয়ার মতো কষ্ট হতে লাগলো আমার

বিকেলবেলা নিজের  ছেলেমানুষী নিজের কাছেই  অসহ্য মনে হলোফোন অফ করে বেড়িয়ে পড়লাম আমি

উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ক্লাবে পৌছে গিয়েছিলামঅসীম আমায় দেখতে পেয়ে সান্ধ্যকালীন একটা আবৃত্তি শো দেখাতে নিয়ে গেলো

রবীন্দ্রনাথের কর্ণকুন্তি সংবাদশুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এরপর আবার কখন জেগে উঠেছিলাম, কিছুই মনে নেইশুধু মনে আছে, মাঝরাতে সেদিন অসীমের দরজাতেই কড়া নেড়েছিলাম রাতটুকুর আশ্রয়ের জন্য

সেদিন সন্ধ্যায় দীপার রাজপুত্রের সাথে আমার দেখা হয়নিনীল রঙের গাড়িতে করে দীপার আর তার রাজপুত্র এসে বসে ছিলো অনেকক্ষনআমি জানিনা দীপার প্রিয় রং নীল কিনাতবে সে হয়তো বেশ পছন্দই করেছিলো সেই নীল গাড়ী আর গাড়ীর নীলরক্তের মালিকটিকে

একদিন আমার সব বন্ধুবান্ধব মিলে মহা সমারোহে দীপার বাসা থেকে মিষ্টিমুখ করে এলোদীপার রাজপুত্র-ভাগ্য দেখে বন্ধুরা চমৎকৃত হলো, বান্ধবীরা হিংসে অনুভব করলোআমি সেখানে থাকার সাহস করে উঠতে পারিনি

মনে মনে বুঝতে  পেরেছিলাম, অচেনা কোনো রাজ্যে হারিয়ে গেছে দীপাতাকে ফিরে পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই আমার

এরপর একটি বছর দীপার সাথে আমার কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়নিএ সময়টা আমার কিছুটা অন্যরকম কেটেছেক্লাসে গিয়ে টের পেতাম দীপা নেইতাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসতামবাসায় এসে মনে হতো সময় কাটানোর মতো কিছু অবশিষ্ট নেইতখন চুপচাপ ফেসবুকে বসে থাকতাম

পারিবারিকভাবেও  আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়লামরাজনৈতিক কারনে বাবাকে জেলে যেতে হলোআমার দু বছরের বড় হাসিখুশী বোনটি ডিভোর্স পেয়ে বাসায় ফিরে এলোএসময় ছোটো মামা আমাদের পাশে এসে দাড়ালেনতিনি মাকে আশ্বাস দিলেন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবেএর কিছুদিন পরে মামার ছোটো কন্যাটি আত্মহত্যা করলো হৃদয়ঘটিত কারনে

আমার চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এলোএকমাত্র পুত্র হিসেবে কিছুই করতে পারিনি আমিপ্রচন্ড রকমের আত্মগ্লানি হতে লাগলো তখনআমিও হয়তো আত্মহত্যা করে ফেলতাম, কিন্তু আমি বড্ড ভীরু হয়ে জন্মগ্রহন করেছিনিজেকে গুটিয়ে নেয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা আমার

বন্ধুদের খোজখবর নিতাম না বলে সবাই একে একে দূরে সরে গেলোঅসীম আর অল্প কয়েকজন শুধু থেকে গেলোতারা মাঝে মাঝে আসতো

অসীম আমার সবচে কাছের বন্ধু ছিলোসে আমাকে তার বাইকে করে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতোআমার মন ভালো করার চেষ্টা করতোতার এই সহজ-সরল চেষ্ঠা দেখে আমি লজ্জা পেতামআমার লজ্জাবোধ তখনো কিছুটা অবশিষ্ট ছিলো

আমি নিস্তার  পেতে চাইছিলামনিজেকে বারবার প্রশ্ন করেও কোনো সদুত্তর খুঁজে পেলাম নাতাই আমি আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসতে চাইলাম

অসীমের সহায়তায় কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে জড়িয়ে গেলামশীতবস্ত্র সংগ্রহ, রক্তদান কর্মসূচী ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লামঅন্তর্জালে সামাজিক যোগাযোগেও কিছুটা আসক্ত হয়ে পড়লামআমার একঘেঁয়ে জীবন কিছুটা স্বস্তিকর হয়ে উঠলো

একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ করেই দীপার ছোটোবোন লোপার সাথে দেখা হয়ে গেলোছোটোবেলায় বাসায় গেলে যে সবার আগে ছুটে এসে আমার কোলে বসে দিদির গান শুনতো, সে অনেক বড় হয়ে গেছে এখন

আমি তাকে এড়াতে চাইছিলাম, তাই না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলামকিন্তু সে আমায় দেখতে পেয়ে লাফিয়ে উঠলোকলকল করে অনেক কথা বলে ফেললো যার বেশীরভাগই আমার মাথায় ঢোকেনিযাবার সময় যখন সে আমায় পাশের দোকান থেকে জীবনানন্দের ধুসর পান্ডুলিপিকিনে উপহার দিলো, কেবল তখনই আমার তাকে আইসক্রীম খাওয়ানোর কথা মনে পড়েছিলো

এরপর থেকে দীপার স্মৃতি আমায় আর কাতর করতো না, আমি হয়তো মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলামচারদিক থেকে আমায় এত এত অন্ধকার গ্রাস করে ফেলেছিলো যে আমি অবসাদগ্রস্তের মতো হয়ে পড়েছিলামনিরাসক্তিই তখন আমার সবচেয়ে বড় আসক্তি হয়ে ধরা দিয়েছিলোতবুও মাঝে মাঝে কোনো নক্ষত্রের রাতে ঘুম ভেঙে যেতো, তখন লোপার দেয়া ধুসর পান্ডুলিপির পাতা ওল্টাতামসুদর্শনাকে মৃত ঘোষনা করে আমি হেমন্তের ঝরা পাতা হয়ে পথের বুকে ঠাঁই নিয়েছিলামনির্জীবের মতো পথের ধারে পড়ে থেকে উপলব্ধি করলাম, এটাই আমার সত্যিকারের নিয়তি

বছরের শেষদিনগুলো বেশ দ্রুতই কেটে গেলো এবং বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দীপার সাথে আবার দেখা হয়ে গেলো, বোধহয় পরিকল্পিতভাবেইআমাকে নীল গাড়ীটা পাঠিয়ে অনেকটা জোর করেই উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলোযে হারমোনিয়ামটা বাজিয়ে একসময় বহু রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলো, সেটার পাশে বসে সে এমনভাবে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইলো, আমার মনে হলো ভুলগুলো যেন আমারই ছিলোআমার কাছে কখনোই কোনো কৈফিয়তের উত্তর ছিলোনা, আমি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম হারমোনিয়ামের রীডগুলোর দিকেওদের জীবনটাও আমার মতোই সাদাকালো, অন্যের আঙুলের ছোঁয়া পেলে তবেই বেজে ওঠে

দীপার মুহুর্মুহু অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হতে থাকলাম আমিমনে হতে লাগলো, সবকিছু আমারই কৃতকর্মের ফলআমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, দীপা যা করেছে- ভালোর জন্যেই করেছেআগে যেভাবে মেয়েটার উপর নির্ভর করে স্বস্তি পেতাম, সেভাবেই নির্ভর করতে ইচ্ছে করলো খুব

মুখে বললাম, ‘সবকিছু অন্যরকমও তো হতে পারতো

দীপা ধরা গলায় বললো, ‘বাবা-মা কখোনই অন্য জাতের ছেলেকে মেনে নিতে পারতো না

কত ছোটো আর সহজ উত্তর, কিন্তু বুক খালি করে দেয়ার জন্য কতই না বিশালদীপার চোখের দিকে তাকালাম আমিসেখানে শিশিরের মতো জল জমে আছেআমার খুব ইচ্ছে করলো সে জলে একটু ছুঁয়ে দিতে

পাশের ঘর থেকে লোপার গানের আওয়াজ শুনতে  পেলামসেই রবীন্দ্রসঙ্গীত, যেটা দীপা আমার চোখে চোখ রেখে গেয়েছিলো একদিন, এই ঘরটাতে বসেহঠাৎ করে আমি দীপার কষ্টগুলো অনুভব করতে পারলাম, ঠিক আগে যেভাবে অনুভব করতামগানের কথাগুলো আবারো নাড়িয়ে দিলো আমায়অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহিরে......... আমি আমার চারপাশে এমনই কোনো আলোকশুন্যতা অনুভব করলাম

অগোছালো পায়ে ঘর হতে বেরিয়ে আসার সময়  চারপাশে একবার তাকালামএকদা খুব পরিচিত এই ঘরটিকে বড় অচেনা লাগলোউঠোনের তুলসীতলায়  একটুক্ষণ দাড়ালামসন্ধ্যাপ্রদীপটি  তেমনি পড়ে আছে, অথচ বদলে গেছে কতকিছুইআর হয়তো এখানে আসা হবে না আমারতবু ভালো থাকুক দীপান্বিতারা


-শাহনেওয়াজ শুভ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন